ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল সোমবার থেকে কাজ শুরু করেছে। এই ঘটনায় একজন নিহত ও দুজন আহত হন।

তদন্তকারীরা জানান, নিম্নমানের উপকরণ, নির্মাণ ত্রুটি, বা রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত সমস্যা এই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত ছিল কি না, তা তারা খতিয়ে দেখবেন। 

মেট্রোরেল সেবা চালুর মাত্র দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া এমন দুর্ঘটনাকে তারা 'অত্যন্ত অস্বাভাবিক' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আবদুর রউফের নেতৃত্বাধীন কমিটি গতকাল তাদের প্রথম সভা শেষে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ২৩ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর গতকাল বেলা ১১টায় মেট্রোরেল পুনরায় সম্পূর্ণরূপে চালু হয়।

এর আগে রোববার দুপুরের দিকে ফার্মগেট স্টেশনের কাছে ৪৩৩ নম্বর মেট্রো রেলের পিলার থেকে একটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে যায়। এতে ৩৫ বছর বয়সী আবুল কালাম আজাদ মারা যান। সেই ঘটনায় আরও দুজন আহত হন।

শরীয়তপুরের বাসিন্দা আজাদ রাজধানীর উত্তরার একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতেন। রোববার রাতে তার স্ত্রী আইরিন আক্তার তেজগাঁও থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করেন।

১৩ মাস আগে একই স্থানে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলীরা অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর এই পরিবহন ব্যবস্থার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বিয়ারিং প্যাড কী?

সেতু ও মেট্রোরেল লাইনের মতো উঁচু কাঠামোতে ভায়াডাক্ট ও পিলারের মধ্যে বিয়ারিং প্যাড স্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে, প্রতিটি পিলারে চারটি বিয়ারিং প্যাড স্থাপন করা হয়েছিল।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইলাস্টোমেরিক বিয়ারিংগুলি সুপারস্ট্রাকচার থেকে পিলারে লোড পাঠায় এবং মেট্রো ট্রেনের চলাচলের ফলে সৃষ্ট কম্পন শোষণ করে।

এই প্যাডগুলোর প্রতিটির ওজন প্রায় ১০০ কেজি। এগুলো কোনো পিন বা স্ক্রু দিয়ে আটকানো হয় না, বরং মেট্রোর উপরের ওজন প্যাডের ওপর চাপ দেয়। সেই চাপের কারণে প্যাড ঠিক জায়গায় থাকে এবং পাশে সরতে পারে না।

গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ৪৩০ নম্বর পিলার থেকে চারটি বিয়ারিং প্যাডের মধ্যে একটি পড়ে যায়, যার ফলে আগারগাঁও-মতিঝিল সেকশনে প্রায় ১১ ঘণ্টা ধরে মেট্রোরেল চলাচল ব্যাহত হয়। তবে তখন কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

তদন্ত শুরু

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটিকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে, কমিটির প্রধান হিসেবে আব্দুর রউফকে রাখা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। কারণ সেপ্টেম্বরের ঘটনার সময় তিনি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

সমালোচনা এড়াতে মন্ত্রণালয় পরে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীকে কমিটিতে যুক্ত করে সদস্য সংখ্যা বাড়ায়। প্রধান উপদেষ্টার সড়ক পরিবহন ও সেতুবিষয়ক বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন এই কমিটির কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছেন।

যোগাযোগ করা হলে আব্দুর রউফ বলেন, কমিটি গত বছরের সেপ্টেম্বরের ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদনে দেওয়া সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করবে। রোববারের ঘটনার কারণও চিহ্নিত করবে এবং কারা দায়ী হতে পারে তা খতিয়ে দেখার পাশাপাশি এবং দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে সুপারিশ দেবে।

সোমবার রাতে দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'আমরা ডিএমটিসিএলের কাছ থেকে নকশা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নথি চেয়েছি, যার মধ্যে ঠিকাদার এবং পরামর্শদাতাদের বিবরণও রয়েছে। ঘটনার সব দিক খতিয়ে দেখব।'

শেখ মঈনুদ্দিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন এবং কমিটির সঙ্গে দূর থেকে সমন্বয় করছেন। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে বিয়ারিং প্যাডটি নষ্ট হওয়ার কথা নয়। এটি বিষয়টিকে বিভ্রান্তিকর করে তুলেছে।

এই প্রতিবেদককে তিনি ফোনে বলেন, নিম্নমানের উপকরণ বা নির্মাণ ত্রুটি  ছিল কি না, অথবা কার্যক্রম শুরু হওয়ার সময় কোনো ত্রুটি নজরে পড়েনি কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।

তিনি আরও বলেন, স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা কারণ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হলে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হবে। 'কোনো ত্রুটি পাওয়া গেলে আমরা সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেব।'

মঈনুদ্দিন আরও বলেন, ডিএমটিসিএলের ঝুঁকিপূর্ণ সরঞ্জামের বার্ষিক বা দ্বিবার্ষিক পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞ দল আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। 'যদি এমন দল না থাকে, তবে তৈরি করতে হবে।'

দেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশটি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে চালু করা হয়। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ পরের বছরের নভেম্বরে চালু হয়।