প্রশাসনের শীর্ষপদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অসন্তোষ
প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে নিয়মিত চাকরিতে থাকা যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে প্রশাসনের ভেতরে অসন্তোষ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সচিবালয়ের অফিসাররা।বেসামরিক প্রশাসনের ৮০ জন সচিব ও সচিব মর্যাদার অফিসারদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করছেন। যার অন্তত ১০ জন সিনিয়র সচিব পদে কর্মরত।অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১৪ মাসে অন্তত ১২ জন সচিব ও সিনিয়র সচিবকে প্রশাসনে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেসব পদে একসঙ্গে সবাইকে চুক্তিভিত্...
প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে নিয়মিত চাকরিতে থাকা যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে প্রশাসনের ভেতরে অসন্তোষ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সচিবালয়ের অফিসাররা।
বেসামরিক প্রশাসনের ৮০ জন সচিব ও সচিব মর্যাদার অফিসারদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ জন চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করছেন। যার অন্তত ১০ জন সিনিয়র সচিব পদে কর্মরত।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১৪ মাসে অন্তত ১২ জন সচিব ও সিনিয়র সচিবকে প্রশাসনে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেসব পদে একসঙ্গে সবাইকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এর আগের কোনো সরকার দেয়নি, এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন সচিব এবং স্বরাষ্ট্র সচিব—সবাই বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদের অনেকে বেশ আগেই অবসরে গিয়েছিলেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদের নিয়মিত চাকরি থেকে ১৫ বছরের বিরতি ছিল। ২০০৯ সালে ওএসডি হওয়ার পর তিনি ২০১৬ সালে অবসরে যান।
মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন সচিব মো. এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি, মহিলা ও শিশুবিষয়ক সচিব মমতাজ আহমেদ এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এম এ আকমল হোসেন আজাদ এবং মো. মোখলেস উর রহমানকেও নিয়মিত চাকরি থেকে দীর্ঘ বিরতির পর চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের ২০০৯ সালে ওএসডি করা হয়েছিল।
সচিবালয়ের নিয়মিত অফিসারদের মতে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রশাসনে ব্যাপক অসন্তোষের কারণ, এটি নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ আটকে দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো সচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অন্তত তিন থেকে চারজন কর্মকর্তাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বঞ্চিত করে।
তবে, জুলাই আইন্দোলনের পর চুক্তিভিত্তিক অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পুনর্নিয়োগ করা ছাড়া সরকারের কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না, উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে এমনটি বলেছেন।
সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকার পূর্ববর্তী প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা কর্মকর্তাদের রাখতে চায়নি। অন্যদিকে, সেই সময়ে অবহেলিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে সচিব পদে নিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত সময় ছিল না। তাই, শুরুতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগই ছিল একমাত্র বিকল্প।
তিনি মনে করেন, 'তবে এই পর্যায়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা উচিত এবং নিয়মিতদের মধ্য থেকে যোগ্য কর্মকর্তাদের সচিব পদে উন্নীত করা উচিত।'
সাবেক সচিব এবং জনপ্রশাসন গবেষক এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, যখন একজন সচিব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান, তখন এটি কার্যত বেশ কিছু যোগ্য কর্মকর্তার জন্য ভালো পদে সুযোগের দরজা বন্ধ করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, কারিগরি পদ বা বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এড়িয়ে চলা উচিত।
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমান বলেন, সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলেও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এই ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা উচিত, কারণ এই প্রথা সিভিল সার্ভিসের স্বাভাবিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করে।
তিনি আরও বলেন, 'যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য তদবির করেন তারা ভালো কর্মকর্তার শ্রেণীতে পড়েন না।'
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট লেখক এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, 'আগের কোনো সরকার কখনও সিভিল সার্ভিসের শীর্ষ চার–পাঁচটি পদ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করেনি।'
'যখন শীর্ষ প্রশাসনিক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন পদোন্নতি প্রত্যাশী কর্মকর্তাদের হতাশ হওয়া স্বাভাবিক। এর ফলে প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমও ব্যাহত হয়, কারণ পদোন্নতির অপেক্ষায় থাকা কর্মকর্তারা দায়িত্বের প্রতি মনোযোগ হারাতে পারেন।'
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কম-বেশি এক বছরের মধ্যেই কমপক্ষে চারজন সচিবকে বদলি করা হয়েছে। এ ধরনের বদলি কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সাধারণত, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে কোনো অফিসারকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হয়। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সরকার প্রয়োজনে তা বন্ধ করে দেয় বা চুক্তি নবায়ন করে। এই ধরনের কর্মকর্তাদের সাধারণত বদলি করা হয় না।
প্রশাসনের নিয়মিতরা বলছেন, চুক্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক অবসরপ্রাপ্ত অফিসার আপগ্রেডেড প্রযুক্তি-চালিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাপ খাইয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, 'যারা ১০-১৫ বছর বিরতির পর চুক্তিতে প্রশাসনে ফিরে এসেছেন, তারা স্পষ্টতই নিজেদের কর্মক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।'
'সরকার কেন তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে বদলি করে এখনও প্রশাসনে রাখবে,' প্রশ্ন তোলেন ওই অফিসার।
গত বছরের নভেম্বরে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোহাম্মদ ইউসুফকে চলতি মাসে পদ থেকে সরিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখন তার কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব নেই, তবুও তিনি সিনিয়র সচিবের সমান বেতন এবং সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
গত বছরের আগস্টে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাত্র তিন মাস পর এম এ আকমল হোসেন আজাদকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। পরে তাকে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে বদলি করা হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব হওয়ার প্রায় নয় মাস পর সিদ্দিক জোবায়েরকে চলতি বছরের ২২ জুলাই পদ থেকে সরিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়।
তাকে জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমিতে বদলি করা হয়। ১২ অক্টোবর মহাপরিচালক, অর্থাৎ সরকার অতিরিক্ত সচিবের জন্য নির্ধারিত পদে একজন সিনিয়র সচিবকে নিয়োগ দেয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ১৩ মাস জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর মোখলেসুর রহমানকে গত মাসে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়।
তবে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে বর্তমান স্বরাষ্ট্র সচিব এবং জনপ্রশাসন সচিবের মতো অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওপর এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, 'অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা, যারা বছরের পর বছর ধরে প্রশাসনের বাইরে রয়েছেন, স্বাভাবিকভাবেই অনেক সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছেন।'
'প্রশাসন একটি যন্ত্রের মতো, যার সঙ্গে অফিসাররা নিয়মিতভাবে আপডেট না থাকলে ঠিক মতো চালাতে পারেন না।'