চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় আবারও বাড়ছে। এর মূল কারণ সুদ পরিশোধ ও বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ব্যয় বৃদ্ধি।

সেই সঙ্গে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠনের জন্য পুঁজিসহায়তা এবং বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন শুরু হলে ব্যয় আরও বাড়তে পারে।

অর্থ বিভাগ, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ও কৃষি মন্ত্রণালয়—এই তিনটি সংস্থা চলতি ২০২৫–২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) মোট ব্যয়ের প্রায় ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫৪ হাজার ৫৭১ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর বেশির ভাগই সুদ ও ভর্তুকির পেছনে গেছে।

এর মধ্যে শুধু সুদ পরিশোধেই লেগেছে প্রায় ৩১ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি।

এই প্রেক্ষাপটে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ১০ নভেম্বর দেশের অর্থনীতি পর্যালোচনা ও সংশোধিত বাজেট প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠক করবেন।

আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার জানুয়ারির মধ্যেই সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত করতে চায় বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

গত মাসে অর্থ বিভাগ সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে ৯ নভেম্বরের মধ্যে সংশোধিত বাজেটের প্রস্তাব পাঠাতে নির্দেশ দিয়েছে।

গত জুনে বাজেট ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন দাবির প্রেক্ষিতে সরকার কিছু ভাতা ও সুবিধা বাড়িয়েছে।

সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ানো হয়েছে, যা অনুন্নয়ন ব্যয়ে বাড়তি প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা যোগ করেছে।

পাশাপাশি যদি বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে ব্যয় আরও বাড়তে পারে।

বেতন কমিশন ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা এর আগে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে কমিশনের কিছু সুপারিশ আংশিকভাবে বাস্তবায়নের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনও ব্যয় বাড়াবে। নির্বাচন কমিশনের জন্য প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হতে পারে।

এদিকে সরকার পাঁচটি সমস্যা-জর্জরিত ইসলামী ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই ব্যাংকের পুঁজির জন্য সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা দিতে চায়।

এর মধ্যে ১০ হাজার কোটি টাকা এই মাসেই নতুন ব্যাংকের হিসাবে স্থানান্তর করা হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষা ও জনগণের আস্থা ফেরাতে এই উদ্যোগকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে।

সরকারের আনুষ্ঠানিক আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন পেলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই মাসের মধ্যেই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দিতে পারে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেছেন, 'নতুন ব্যাংকে পুঁজিসহায়তা ইতিবাচক হতে পারে, যদি এর সঙ্গে টেকসই সংস্কার কার্যক্রম চালু থাকে।'

তিনি বলেন, 'মূল প্রশ্ন হলো—ব্যাংক খাতে যে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা কি পরবর্তী সরকারও অব্যাহত রাখবে? এর আগেও ব্যাংকগুলোর পুঁজিতে বাজেট সহায়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সংস্কার অব্যাহত না থাকলে আগের মতোই সরকারি অর্থ অপচয় হবে।'

তার মতে, 'যেভাবে রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি জরুরি, অর্থনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও তেমন রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে অনেক আলোচনা দেখি, কিন্তু অর্থনৈতিক ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এমন আলোচনা প্রায় নেই।'

গত অর্থবছরেও সংশোধিত বাজেটে অনুন্নয়ন ব্যয় বেড়েছিল। কারণ সরকারকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সার খাতে বকেয়া পরিশোধ করতে হয়েছিল। এর ফলে উন্নয়ন বাজেট কিছুটা কমাতে হয়।

চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট সরকারি ব্যয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকায়।

অর্থ বিভাগ সবচেয়ে বেশি ব্যয় করেছে, ৪০ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এই ব্যয় হয়েছে মূলত অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ভর্তুকি এবং বিভিন্ন প্রণোদনা প্রদানে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ব্যয় করেছে ৬ হাজার ১৫৯ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই বৈদেশিক ঋণের মূলধন ও সুদ পরিশোধে গেছে।

কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে ৭ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা, মূলত সার ভর্তুকি ও কৃষি প্রণোদনায়।

শিক্ষা সম্পর্কিত তিনটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ব্যয় করেছে ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে ৫ হাজার ৬৫৯ কোটি টাকা, জননিরাপত্তা বিভাগ ৪ হাজার ৬৫৭ কোটি এবং খাদ্য মন্ত্রণালয় ৫ হাজার ৮০৩ কোটি টাকা।

অন্যদিকে, রাজস্ব আদায় বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ১৭ শতাংশ—যা ১ লাখ ১৭ হাজার ১১৭ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। গত বছর এই প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

অনুন্নয়ন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অর্থ বিভাগ লাগাম টানতে সংশোধিত বাজেটে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, অনুন্নয়ন বাজেটের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় বন্ধ থাকবে। উন্নয়ন বাজেটে ভূমি অধিগ্রহণ তখনই অনুমোদন পাবে, যখন সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে অর্থ বিভাগের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যাবে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় ছাড়া অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ে নতুন ভবন (বাসস্থান বা অফিস) নির্মাণের বরাদ্দ শুধু সেই প্রকল্পেই দেওয়া হবে, যেখানে কাজের আদেশ ইতোমধ্যে জারি হয়েছে।

এছাড়া, যানবাহন কেনা, বিদেশ সফর ও অন্যান্য ঐচ্ছিক ব্যয়েও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

ড. সেলিম রায়হান বলেন, 'আসন্ন সংশোধিত বাজেটটি পরবর্তী সরকারের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে। কারণ সাধারণত বাজেটের বড় অংশ বাস্তবায়ন হয় অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে।'

তার মতে, 'এই প্রেক্ষাপটে সংশোধিত বাজেটের মধ্যে এমন একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা থাকতে হবে, যা পরবর্তী প্রশাসন অনুসরণ করতে পারে।'

তিনি আরও বলেন, 'রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি, যেন নতুন সরকারের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক চাপ না পড়ে।'