দেশের উপকূলীয় জনপদে ২০০৭ সালে আজকের এই দিনে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় 'সিডর'। সেই তাণ্ডবের পর পেরিয়ে গেছে ১৮ বছর। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সে রাতের দুঃসহ স্মৃতি আজো যেন টাটকা শরণখোলার মানুষের মনে।

ঘূর্ণিঝড় সিডরের আঘাতে শরণখোলা উপজেলা পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। শুধু এই উপজেলাতেই মারা গিয়েছিলেন অন্তত ৯০৮ জন মানুষ। ঘরবাড়ি, কৃষি জমি, আশ্রয়কেন্দ্র—সব ধ্বংস করে উপকূলীয় এই জনপদের জীবনের গতিপথই বদলে দিয়েছিল সিডর।

ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় এখন ভরে ওঠে সাউথখালী ইউনিয়নের চালিতাবুনিয়া গ্রাম। অথচ, শান্ত এই গ্রামের মানুষের মনে এখনো সব হারানোর আশঙ্কা। সিডরের আঘাতের পর যারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের দিন কাটে শঙ্কায়।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাঙা বেড়িবাঁধ, ভাঙ্গন প্রবণ নদীর তীর আর উপকূলীয় অনিশ্চিত পরিবেশ তাদের শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত নদীর তীরে দাঁড়াতেই গ্রামের বাসিন্দাদের মনে পড়ে ভয়ঙ্কর সেই রাতের কথা।

তাদেরই একজন চালিতাবুনিয়া গ্রামের দেলোয়ার তালুকদার (৪৪)।  সিডরের রাতে পাঁচ বছর বয়সী ছেলে ও চার মাস বয়সী মেয়েকে হারিয়েছিলেন তিনি।

দুঃসহ সেই স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে দেলোয়ারের গলা বারবার কেঁপে উঠে। বলেন, 'সেদিন সারাদিন হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ স্রোতের সঙ্গে পানি ঢুকে সব তছনছ হয়ে গেল। আমার ছেলেটা তখন আমার অসুস্থ মায়ের কাছে ছিল। পানি বাড়তেই আমি যখন ছেলেকে মায়ের কোল থেকে নিতে গেলাম, তখনই ঢেউয়ের আঘাতে গোটা ঘর ভেঙে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল।'

'আমার চার মাস বয়সী মেয়েটা ছিল ওর মায়ের কোলে। কখন যে স্রোতের তোড়ে তারা দুজনেই ভেসে গেল, টেরই পাইনি,' যোগ করেন তিনি।

দেলোয়ার বলেন, 'সিডরের আঘাতে বেড়িবাঁধ ভাঙার পরে যে বেড়িবাঁধ করা হয়েছে, সেটা বালু দিয়ে নির্মাণ করেছে বলেই বারবার ভেঙে পড়ছে। নদী শাসন করা না হলে আতঙ্ক তো থাকবেই। এখনো ভাঙা টিনের ঘরে থাকছি। আগের জীবনে ফিরতে পারিনি।'

উপকূলের এই বাসিন্দাদের কাছে সিডর শুধু এক ঘূর্ণিঝড় না, বরং জীবনকে দুভাগে বিভক্ত করা এক নির্মম বাস্তবতা।

৫৫ বছর বয়সী শাহজাহান মোল্লার বাড়িও চালিতাবুনিয়ায়। তিনি বলেন, 'জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে আমরা নৌকায় আশ্রয় নিই। তারপরও আমার পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছি। এখনো আমরা আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছি।'

তিনি আরও বলেন, 'যে বাঁধ বানানো হয়েছে, তার অবস্থা ভালো না। নদীর তীর ঠিকভাবে সুরক্ষিত না হলে এখানে মানুষের টিকে থাকা অসম্ভব। পুরো এলাকার মানুষ এখনো চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।'

স্থানীয় সাংবাদিক শাহীন হাওলাদার বলেন, 'সিডরের পর যেসব বাঁধ তৈরি হয়েছে, সেগুলোর আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর এখনো হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গেছে। কঠোর নজরদারির মাধ্যমে সরকার টেকসই বাঁধ তৈরি না করলে শরণখোলা ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে।'

তিনি বলেন, 'বাগেরহাটের জনপ্রিয় বগী বন্দর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সিডরে যারা বাবা-মা, সন্তান বা স্বজনদের হারিয়েছেন, তারা এখন আর কোনো বিশেষ অধিকার চান না। তারা চান শুধু জীবনের নিরাপত্তা। তাদের এখন একমাত্র দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ।'

শরণখোলা ঘুরে দেখা যায়, চতুর্দিকে এখন পাকা ধানখেতের মনোরম দৃশ্য। ইতোমধ্যেই ধান পেকে উঠেছে। পুরো এলাকা যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোনো ছবি।

কিন্তু এখানকার মানুষ জানেন, আরেকটি ঘূর্ণিঝড় এলে এই সোনালি খেতের সর্বত্রই মৃত্যুপুরী পরিণত হবে।

শরণখোলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাবিবুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেছি। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। ধাপে ধাপে টেকসই বাঁধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেব।'

তিনি বলেন, 'আমি ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব নিলেও বাঁধের বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত জরুরি বলে মনে হয়েছে।'

সিডরের আঘাতের ১৮ বছর পরেও শরণখোলার মানুষের দাবি একটাই—টেকসই বাঁধ। তারা কোনো ক্ষতিপূরণ চান না। তাদের চাওয়া, বলেশ্বর নদী যেন আর কোনো প্রাণ কেড়ে না নেয়। যে জীবন, সংসার আর ভূমিকে নিয়ে তারা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন, তা যেন সুরক্ষিত থাকে।