ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী যে আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিলো, সে আশা আর এখন দেখতে পাচ্ছি না। 

আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির শফিকুল কবির মিলনায়তনে 'পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতা সংস্কৃতি' শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। এ সভার আয়োজন করে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলন।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক বলেন, ৭২ এর সংবিধানে 'দেশের জনগণ বাঙালি বলে পরিচিত হবেন' বলে যে ধারাটি ছিলো, সেটি প্রস্তাবিত জুলাই সনদ থেকে বাতিল করে 'বাংলাদেশ একটি বহু জাতিগোষ্ঠীর, বহু সংস্কৃতির দেশ যেখানে সব জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার চর্চা করতে পারবে' ধারাটি যুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাঙালি আধিপত্যবাদী জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। 

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সেনাবাহিনীই একমাত্র শক্তি যারা চাইলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী মানুষদের অধিকার এবং শান্তি আনতে পারেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এসব গণহত্যার ফলে দুই দশকে কমপক্ষে এক লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়।

খায়রুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (১৯৯৮-২০১১ সাল) ও কাপেং ফাউন্ডেশনের (২০১২-২০২৪ সাল) তথ্যানুসারে গত ২৭ বছরে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারসংক্রান্ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন নয় হাজার ১৬২ জন। এসব ঘটনার কোনোটির সুষ্ঠু বিচার করা হয়নি। যার ফলে এ ধরনের ঘটনাগুলো বারবার সংগঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই ধরনের কাঠামোগত বিচারহীনতা দূর করতে হলে শুধু নীতি নয়, বরং আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। 

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক অধিকারসহ মৌলিক মানবাধিকারকে অস্বীকার করার যে খেলা পাকিস্তান আমলে শাসকরা শুরু করেছিলেন সেটি মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়েও চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওই অঞ্চলের গণমানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছিল, সে চুক্তিটিও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। 

তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গত ৫০ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ওপর সংগঠিত হত্যা, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে তদন্ত করে ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু বিচারের আহ্বান জানান। 

বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, রাষ্ট্রের সব মানুষের মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এ দায়িত্ব যদি রাষ্ট্র সঠিকভাবে পালন করতো, তাহলে আজ আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষদের নিয়ে আলোচনা করতে হতো না। 

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে দেশের গণমানুষের অধিকার সংরক্ষণ করার জন্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।  

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন হক বলেন, সীমান্ত রক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী বাহিনী রাখা দরকার। কিন্তু সে বাহিনী যেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কোনো ধরনের ব্যাঘাত তৈরি না করে। 

তিনি আরও বলেন, কল্পনা চাকমাকে অপহরণের এত বছর হয়ে গেলো, তবুও আমরা তার কোনো হদিস পাচ্ছি না। বর্তমানেও বম নারী-পুরুষসহ অনেকেই কারাগারে রয়েছেন, যা খুব বেদনাদায়ক। তাদের শিগগির মুক্তি দেওয়া উচিত। 

পার্বত্য চট্টগ্রামে যেসব গুম, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সঠিক ডকুমেন্টেশনের জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, মানবাধিকারবিষয়ক যে আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনুস্বাক্ষর করেছে, সেগুলোর যে হালনাগাদ করা হয়, তাতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মতামত নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে দেশের প্রগতিশীল মানুষদের আরও এগিয়ে আসতে হবে।