বাংলাদেশের মানুষ ভালো শাসনতন্ত্র চায়, বাংলাদেশের মানুষ সুশাসন চায়। এখানে জবাবদিহিতা থাকবে, দুর্নীতি থাকবে না—সেটা তো একদিনে আমরা ডায়ালগ করে পাব না, এমন মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

আজ শনিবার সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।

ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলেও এ সময় জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, 'অনেকে বলছেন জুলাই চার্টার নিয়ে তো অনিশ্চয়তা আছে। এই ডিবেটগুলো কিন্তু অনেক জায়গায় ১০-১৫ বছর ধরেও চলে। শাসনতন্ত্র কীভাবে করবেন, কোনটা আপনার জন্য ভালো, কুইক ফিক্স বলে কিছু নাই।'

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে প্রেস সচিব বলেন, 'দ্বিমত তো থাকবেই! আপনি একটা কথা বলবেন, আরেকজন একটা কথা বলবে, তার পরে দ্বিমতের ভিত্তিতেই একটা সিদ্ধান্ত হবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত না নিতে পারে, সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর যে অর্পিত দায়িত্ব, সে দায়িত্ব অনুসারে তারা তাদের একটা সিদ্ধান্ত নেবে। এটা খুব দ্রুতই হবে, এমন না যে অনেক দিন পরে—যাতে করে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো ধরনের কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে।'

নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে পূর্ববর্তী বক্তার কথার জের ধরে তিনি বলেন, 'আমরা তো সবাই প্রযুক্তির মধ্যেই বাস করছি। সরকারের যেকোনো পরিকল্পনা করতে গেলে পুরোটাই তো প্রযুক্তি নির্ভর। আমাদের আধুনিক জীবনে প্রযুক্তি হলো বাতাস-আকাশ। নির্বাচনী মূল প্রচারণাটা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করতে হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে আমরা বেশিরভাগ মেসেজ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিচ্ছি। অনেকে বলছেন সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর। আমি সোশ্যাল মিডিয়া কেন দেবো না? একটা বড় ইংরেজি পত্রিকার সার্কুলেশন আট হাজার। আর আমরা যদি একটা ভালো মেসেজ দিতে চাই, সোশ্যাল মিডিয়াতে সেটা রিচ করে এক কোটি লোকের কাছে।'

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে নিজেদের গুরুত্ব বাড়াতে মুখরোচক কথা বলেন—মন্তব্য করে প্রেস সচিব বলেন, 'কিছু কিছু থিংক ট্যাংক বলতে চান যে, জুলাই চার্টার হচ্ছে কিন্তু কৃষকের সঙ্গে কথা হয়নি। নারী গ্রুপের সঙ্গে কথা হয়নি বা লেবার গ্রুপের সঙ্গে কথা হয়নি। আশ্চর্য লাগে! এই কথাগুলো কীভাবে উনারা বলেন? রাজনৈতিক দল, যাদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কথা বললো, তাহলে তারা কি এই গ্রুপগুলোকে রিপ্রেজেন্ট করে না?'

জুলাই চার্টারে সব কিছু এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'শাসনতান্ত্রিক বিষয়গুলো প্রমিন্যান্টলি এসেছে, যেটা পত্রিকায় আপনারা রিফ্লেকশন দেখেছেন। কিন্তু অন্যান্য বিষয় কি আসে নাই? সবই এসেছে। আর সবাই যদি ভাবেন যে আমরা নয় মাসে কুইক ফিক্স করে ফেলবো, সেটাও তো হয় না। এই ডায়ালগটা হয়তো এমন হতে পারে, ইলেকশনের পরে আবার নতুন করে ডায়ালগ হতে পারে।'

নেপালের উদাহরণ টেনে শফিকুল বলেন, 'ওদের নতুন একটা কনস্টিটিউশন—সামন্তবাদ পরবর্তী সংবিধান করতে নয় বছর লেগে গেছে, একদিন না। ওদেরও তো অনেকগুলো সিরিয়াস পলিটিক্যাল পার্টি আছে, যাদের জনগণের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক আছে।'

'বাংলাদেশের মানুষ একটা বেটার শাসনতন্ত্র চায়, বাংলাদেশের মানুষ সুশাসন চায়। এখানে জবাবদিহিতা থাকবে, দুর্নীতি থাকবে না—সেটা তো একদিনে আমরা ডায়ালগ করে পাব না। আর যদি বলেন যে এই পুরো ডায়ালগটাও ভুল, এটা খুবই আনপ্রেসিডেনটেড একটা ডায়ালগ হয়েছে এবং আমাদের পলিটিক্যাল পার্টিগুলো খুব সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। মোট চার হাজার পাতা রেকর্ডে করা হয়েছে। এটা আমরা পাবলিশ করছি, সবাই পাবেন, দেখবেন,' যোগ করেন তিনি।

রাজনৈতিক দল ও গবেষকরা ভিডিও ফুটেজ দেখতে পারবেন—কোন বিষয়ে কার অবস্থান কী ছিল বলেও এ সময় জানান প্রেস সচিব।

শফিকুল আরও বলেন, 'অনেকে ভাবছেন যে এই আলাপগুলো একদিনে কেন সম্ভব না? আসলে একদিনে সম্ভব না। অনেকে ভাবছেন, এক সপ্তাহে বসলে ঠিক করা যায়। এটা ১৮০ মিলিয়ন জনগণকে রিপ্রেজেন্ট করা। শাসনতন্ত্র কীভাবে হবে, কোথায় আমাদের ভুল-ত্রুটি হয়েছে, আমরা যেন আরেকটা শেখ হাসিনার মতো স্বৈরশাসন না পাই এবং এটা যেন সত্যিকার অর্থেই প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার হয় সেটা নিয়েই তো সবার এই আয়োজন।'

নির্বাচনী ইশতেহারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে পুরোনো কর্মসংস্থান সংরক্ষণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'গোপালগঞ্জ কাশিয়ানী আমি রেললাইন বানিয়ে রেখেছি, কেউ চড়ে না। যেখানে আমার চট্টগ্রাম টু ঢাকা একটা ডেডিকেটেড হাই স্পিড রেললাইন করা দরকার বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সেটা আমরা করেছি ঢাকা টু খুলনা। যেখানে দিনে ৫০০ কী এক হাজার লোক হয়। এটা কি আমার গ্রোথ এরিয়া? পুরোটাই করা হয়েছে গোপালগঞ্জকে যাতে টাচ করে যাওয়া যায়। পাঁচ বিলিয়ন ডলার, একটা-দুইটা টাকা না! আমরা সারা জীবন দেখছি যে আমার গ্রোথ ঢাকা-চট্টগ্রাম। এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে একটি গাড়ি ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার চলতে পারে। পাঁচ বছর পরে ১০ কিলোমিটারও দিতে পারবে না। এখানে কতটা জরুরি ছিল।'

'পদ্মা সেতু করা হয়েছে, ভালো। তাও তো পদ্মা সেতুতে কত টাকা বাড়তি খরচ করা হয়েছে। কী ভয়াবহ! একটা এক বিলিয়ন ডলারের বেশি দিয়ে টানেল করেছেন, আনোয়ারাতে তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। এই পুরো টানেলের পেছনে ছিলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। ১৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে টানেল হয়েছে, তার মধ্যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটা সেভেন স্টার হোটেল করেছে আনোয়ারাতে। কারণ উনার বাসায় যাওয়া যাবে না, যাতে উনি ওই সাত তারা হোটেলে থাকতে পারেন। এই কাজগুলো হয়েছে। এখন এটাকে রেকটিফাই করা এই পুরোটাকে আবার নতুন করে, সেই জায়গায় ইনভেস্টমেন্ট করা, সে জন্য তো রিসোর্স মোবিলাইজ করতে হয়। সেই রেভিনিউ তো আমার নাই! বাংলাদেশের জিডিপি-রেভিনিউ দেখেন, এশিয়ায় সবচেয়ে কম। হয়তোবা আফগানিস্তানের একটু উপরে আছি। আমার একজন সচিব বেতন পান এক হাজার ডলারের একটু বেশি। এটা একটা বেতন হলো! পুরো পৃথিবীর মধ্যে ওয়ান অব দ্য লোয়েস্ট। আপনি এখন বাড়াতে যাবেন? আপনার তো রেভিনিউ নাই!' বলেন তিনি।

প্রেস সচিব আরও বলেন, 'শেখ হাসিনা চোরতন্ত্র রেখে গেছেন, এটা কল্পনা করা যায় না। ভয়াবহ! আমরা বলি অনেকে ভাবেন যে আমরা এটা পলিটিক্যাল কথা বলছি, কিন্তু এটা অবিশ্বাস্য চ্যালেঞ্জ।'

শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, 'আজকেও তিনি বলেছেন যারা জুলাই আন্দোলন করেছে সবাই টেরোরিস্ট।'

'১৮ কোটি মানুষকে সন্ত্রাসী বলে উনি ক্ষমতায় আসতে চাচ্ছেন। আপনি যখন একজন লোককে টেরোরিস্ট বলবেন, তাকে হত্যাযোগ্য করছেন। উনি চান ১৮০ মিলিয়ন লোককে হত্যা করে উনি ক্ষমতায় আসবেন। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্ত একটা অবস্থান নিতে হবে। কেননা এটা আমাদের জন্য এক্সিটেন্সিয়াল থ্রেট,' যোগ করেন তিনি।