প্রাণীকল্যাণে রাষ্ট্রের দায়: প্রয়োজন নীতিমালা প্রণয়ন, আইনের প্রয়োগ ও সমন্বয়
প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯ পাস হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ছয় বছর। কিন্তু এখনো পৌরসভা-সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে কুকুর-বিড়াল হত্যা ও নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় নিয়মিত।আইন থাকলেও এর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে, যার ফলে প্রকাশ্য হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় দায়বোধের ঘাটতি। পাশাপাশি দেখা যায় প্রয়োজনীয় নীতিমালার অভাব ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা।সোমবার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত এক রাউন্ডটেবিল কনফারেন্সে এসব বিষয় উঠে আসে। 'পথ কুকুর ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব: শহরের প্রাণী কল্যাণে মানবিক ও জ...
প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯ পাস হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ছয় বছর। কিন্তু এখনো পৌরসভা-সিটি করপোরেশনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে কুকুর-বিড়াল হত্যা ও নির্যাতনের খবর পাওয়া যায় নিয়মিত।
আইন থাকলেও এর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে, যার ফলে প্রকাশ্য হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় দায়বোধের ঘাটতি। পাশাপাশি দেখা যায় প্রয়োজনীয় নীতিমালার অভাব ও সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা।
সোমবার দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত এক রাউন্ডটেবিল কনফারেন্সে এসব বিষয় উঠে আসে। 'পথ কুকুর ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব: শহরের প্রাণী কল্যাণে মানবিক ও জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া তৈরির উপায়' শীর্ষক এ আলোচনায় অংশ নেন সরকারি কর্মকর্তা, প্রাণীকল্যাণে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, আইনজীবী, ভেটেরিনারি চিকিৎসক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক।
ডেইলি স্টারের সাংবাদিক নাজিবা বাশারের সঞ্চালনায় সরকারের ভূমিকা ও জবাবদিহি, সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব, এনজিওদের নীতিগত সহযোগিতা, আইনের প্রয়োগ ও সংস্কার, ভেটেরিনারি চিকিৎসার প্রেক্ষিত, গণমাধ্যমের ভূমিকা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দায় নিয়ে মতামত দিয়েছেন অংশগ্রহণকারীরা।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (ঔষধাগার) মো. শাহিনুর আলম তার বক্তব্যে প্রথমেই প্রাণীকল্যাণ আইনের উদ্দেশ্য উল্লেখ করেন, 'প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ বন্ধ করা এবং একটি মানবিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রাণী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।'
'তবে আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে হচ্ছে না' স্বীকার করে তিনি বলেন, 'আমরা দেখি, এখনো কোথাও কোথাও কুকুর হত্যার মতো ঘটনা ঘটে। কিন্তু আমি বলতে চাই, অতীতের তুলনায় পরিস্থিতি অনেক উন্নত হয়েছে। আগে পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই এসব প্রাণীদের নিধন করা হতো। কিন্তু এখন এই চর্চা বন্ধ হয়েছে।'
রাস্তার কুকুর নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'অনেকে মনে করে সব রাস্তার কুকুরই র্যাবিসে আক্রান্ত। কেউ আবার কুকুর মানেই ভয় বা অশুভের প্রতীক বলে মনে করেন। এসব ভ্রান্ত ধারণার কারণে প্রাণীর প্রতি অমানবিক আচরণ করে অনেকে।'
'জনসচেতনতা বাড়ানোই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ' উল্লেখ করে অধিদপ্তরের পরিচালক বলেন, 'আমরা মনে করি, যত বেশি সচেতনতা বাড়ানো যাবে, তত দ্রুত এই নিষ্ঠুরতা কমে আসবে। অধিদপ্তর একা নয়—আমরা বিভিন্ন প্রাণীকল্যাণ সংগঠন, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং এফএওর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি।'
তিনি জানান, ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রায় ২৯ লাখ কুকুর ও বিড়ালকে র্যাবিস প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে। প্রথম দফায় ৬৪টি জেলায় টিকাদান সম্পন্ন হয়েছে, দ্বিতীয় দফায় ৪৫ জেলায় ও তৃতীয় দফায় ৮ জেলায় টিকা দেওয়া হয়েছে।
সরকার প্রাণীকল্যাণকে উপেক্ষা করছে না বলে দাবি করেন শাহীনুর আলম। তিনি জানান, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর পথের প্রাণীদের জন্য 'পপুলেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভ্যাক্সিনেশন' শীর্ষক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে কুকুরের সংখ্যা ব্যবস্থাপনা, নিউটার ও টিকাদান কার্যক্রম আরও গতিশীল হবে।
'আমরা চাই স্থানীয় প্রশাসন ও প্রাণীকল্যাণ সংগঠনগুলোর সঙ্গে আরও মজবুত সমন্বয় গড়ে তুলতে, যেন আইনের সঠিক প্রয়োগ করা যায়। আইন কোনো একক প্রতিষ্ঠানের হাতে কার্যকর হয় না—এর প্রয়োগে নাগরিক সচেতনতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাও সমান জরুরি। কোনো অমানবিক ঘটনার খবর পেলে সেটিকে প্রতিরোধ করা শুধু সরকারের নয়, বরং আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব,' বলেন তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথমেই প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব সম্পর্কে তার সচেতনতার বিষয়টি জানান। বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সিএনভিআর (ধরা, নিউটার করা, টিকা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া) বা বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করছে। উত্তর সিটিতে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৫ হাজার কুকুরকে সিএনভিআর প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হয়।
তবে, পরবর্তীতে সরকারি ই-জিপি টেন্ডার সিস্টেমের জটিলতায় এ কার্যক্রম আর এগোয়নি বলে জানান তিনি।
তবে সিটি করপোরেশন বিক্ষিপ্তভাবে কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস। বিশেষ করে নাগরিকদের অভিযোগের ভিত্তিতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তারা কিছু এলাকায় টিকাদান ও নিউটার কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন বলে জানান তিনি।
সিটি করপোরেশন আইনের সীমাবদ্ধতারও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। বলেন, 'আইন অনুযায়ী আমরা শুধু পশুরোগ ও বেওয়ারিশ পশু সংক্রান্ত দুটি ধারা ব্যবহার করতে পারি। এই ধারাকেও অনেক সময় ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়। এর বাইরে প্রাণীকল্যাণ আইনেও সিটি করপোরেশনকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। তবুও আমরা স্বপ্রণোদিতভাবে কাজ করছি।'
সম্প্রতি মিরপুর এলাকায় প্রাণী বিক্রির হাটে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, 'প্রাণীদের প্রতি অমানবিক আচরণ এখনো কিছু জায়গায় হচ্ছে, এটা রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। সচেতনতা বৃদ্ধি একটি ধারাবাহিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যা ধীরে ধীরে ফল দেবে।'
'প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সমন্বয় শক্তিশালী নয়' স্বীকার করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা ইমরুল কায়েস বলেন, 'আমাদের মধ্যে আরও নিয়মিত যোগাযোগ ও যৌথ কর্মপরিকল্পনার প্রয়োজন আছে। অধিদপ্তর যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তার আওতায় ঢাকা সিটি করপোরেশনও থাকবে। আমি বলতে চাই—যেখানে কোনো সিটি করপোরেশন বা পৌর প্রশাসনের কর্মকর্তা কুকুর হত্যার ঘটনায় যুক্ত থাকবেন, সেখানে দায় তাদেরই নিতে হবে। কারণ প্রতিটি সিটি করপোরেশনেরই একটি ভেটেরিনারি ইউনিট আছে—জনবল কম হোক বা বেশি—তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।'
তিনি সিটি করপোরেশনের জনস্বাস্থ্য ও স্যানিটেশন নীতিমালায় প্রাণীকল্যাণ অন্তর্ভুক্ত করাকে সময়ের দাবি হিসেবে উল্লেখ করেন। 'রাস্তার প্রাণীরা আমাদের নগরবাসীর জীবনপরিসরের অংশ—তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আসলে মানবিক নগর ব্যবস্থাপনার অঙ্গ,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে কুকুর নিধন বন্ধে দীর্ঘ লড়াই করেছে বেসরকারি সংগঠন অভয়ারণ্য-বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। এর প্রতিষ্ঠাতা রুবাইয়া আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, '২০০৯ থেকে ২০১২—পুরো তিন বছর লেগেছিল সরকারকে বোঝাতে যে কুকুর হত্যা কোনো সমাধান নয়। অবশেষে সরকার যখন এ বিষয়ে আশ্বস্ত হলো, তখন আমাদের জানানো হয় যে তারা সিএনভিআর বাস্তবায়নে আগ্রহী, তবে তাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ নেই।'
'আমাদের বলা হয়, যদি আমরা কোনো আন্তর্জাতিক পার্টনার আনতে পারি যারা কাজটি শুরু করবে, সরকার পরে নিজেদের সম্পদ গুছিয়ে নেবে এবং উদ্যোগটি গ্রহণ করবে। ২০১২ সালে আমরা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও মার্কিন প্রাণিকল্যাণ সংস্থা হিউম্যান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করি,' বলেন তিনি।
'এর আওতায় প্রথমে ঢাকায় এক হাজার কুকুরের নিউটার ও ভ্যাক্সিনেটেড করা হয়। শর্ত ছিল—এরপর দুই সিটি করপোরেশন তাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে কার্যক্রমটি চালিয়ে যাবে। আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি রেখেছিলাম, কিন্তু সিটি করপোরেশন রাখেনি। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মেয়র না থাকায় সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবুও আমরা আমাদের নিজস্ব সম্পদ দিয়ে এবং বিভিন্ন শুভানুধ্যায়ীর সহায়তায় প্রোগ্রামটি চালু রাখি,' বলেন রুবাইয়া।
তিনি জানান, ২০১৬ সালে ঢাকায় নতুন দুই মেয়র আসেন—উত্তরে আনিসুল হক, দক্ষিণে সাঈদ খোকন। তখন মার্কিন ওই সংস্থাটি প্রস্তাব দেয়—প্রতিটি সিটিতে ২ হাজার কুকুরের স্পে ও নিউটার প্রোগ্রাম তারা স্পন্সর করবে। সাঈদ খোকন প্রস্তাবটি নাকচ করেন, কিন্তু আনিসুল হক রাজি হন।
'পরে আমরা উত্তর সিটিতে ৪ হাজার কুকুরের দায়িত্ব নেই। মহাখালীতে এক লাখ ডলার ব্যয়ে পূর্ণাঙ্গ সিএনভিআর সেন্টার স্থাপন করা হয়। আমরা স্পে ও নিউটার সম্পন্ন করি এবং প্রতিটি কুকুরের তথ্য রেকর্ডভুক্ত করি,' বলেন তিনি।
তিনি জানান, আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ওই সমঝোতা স্মারক আর কার্যকর থাকেনি। নতুন মেয়রের দায়িত্ব নেওয়া আতিকুল ইসলাম কাজটিকে টেন্ডার জটিলতায় ফেলে দেন।
'সে সময় অনেকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সরকারি সংস্থাকে বাদ দিয়ে নিজেদের মতো করতে,' বলেন রুবাইয়া।
কিন্তু, বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া ছিল লক্ষ্য। 'আমাদের লক্ষ্য কখনোই নিজেদের প্রোগ্রাম চালানো ছিল না। বরং, বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অংশ করা ছিল লক্ষ্য। কারণ বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের নীতিতে ঢুকে গেলে, কেউ আর পরিবর্তন করতে পারবে না,' বলেন তিনি।
কোভিডের সময় স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন এলাকায় 'কুকুরকে খাওয়ানোর' চর্চা বেড়ে যাওয়ার কারণে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শহরে কুকুরের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান 'অভয়ারণ্য'র প্রতিষ্ঠাতা।
অভিজ্ঞতা থেকে রুবাইয়া বলেন, 'আমরা ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বছর ডগ পপুলেশন সেনসাস করে আসছি। কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাভাবিক হারে ওদের জনসংখ্যা ওঠানামা করে প্রায় ২৩ শতাংশ। অথচ ২০১৬ সালে যেখানে ছিল ৩৮ হাজার কুকুর, সেখানে ২০২২ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩ হাজারে—যা অকল্পনীয়। ফলে আমরা এখন কুকুরের সংখ্যার কারণে সম্পূর্ণ অব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় পড়ে গেছি।'
ঢাকার কুকুরের বর্তমান সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'আমরা চাইলে এখনো এটাকে একটা পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। আমরা বারবার বলছি—এখানে কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা নিতে হবে। কারণ বেসরকারি সংগঠন একা এই লড়াই টিকিয়ে রাখতে পারবে না।'
'এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেক অদক্ষ ব্যক্তি নিজেদের মতো করে রাস্তার কুকুরের চিকিৎসা দিচ্ছেন—কেউ কেমোথেরাপি দিচ্ছেন, কেউ অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিচ্ছেন—যা প্রাণীকল্যাণের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। এটি নিয়ন্ত্রণের কোনো কাঠামো নেই,' বলেন রুবাইয়া।
প্রাণীকল্যাণ আইনের প্রয়োগ ও সংস্কার নিয়ে কথা বলেন আইনজীবী সিনথিয়া ফরিদ। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই, সমস্যা হচ্ছে, আইন প্রয়োগের অভাব। প্রাণীকল্যাণের ক্ষেত্রে আমরা বারবার দেখি—মানুষের মধ্যে সহানুভূতি আছে, উদ্বেগ আছে, কিন্তু এটি কেবল আবেগের বিষয় নয়, এটি আন্তঃসম্পর্কিত, যেখানে নগর পরিচালনা থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণ পর্যন্ত জড়িয়ে আছে।'
তিনি তিন স্তরের জরুরি সমন্বয়ের আহ্বান জানান—রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে কাঠামোগত সমন্বয়, প্রাণী অধিকার সংগঠন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে নীতিগত সহযোগিতা।
প্রাণীকল্যাণ আইন ২০১৯ একটি 'ঐতিহাসিক অর্জন' হলেও আইনে 'অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড গঠনে'র বিধান থাকলেও সেটি এখনো প্রণীত হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।
'প্রশ্ন থেকে যায়—কার এখতিয়ারে মামলা হবে? কোথায় অভিযোগ জানানো যাবে?' উদাহরণ হিসেবে সম্প্রতি রাজধানীর জাপান গার্ডেন সিটির একটি ঘটনার উল্লেখ করেন সিনথিয়া ফরিদ। সেখানে কুকুরকে বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। তিনি প্রাণীকল্যাণ আইনের আওতায় অভিযোগ করার পরামর্শ দেন।
'কিন্তু তারা পেনাল কোডের আশ্রয় নেন। এতে পুলিশ ও প্রশাসন মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে, তদন্ত শুরু হয়, কিন্তু প্রক্রিয়াটি ধীরগতির হয়ে পড়ে,' বলেন এই আইনজীবী।
একই ঘটনায় একাধিক আইনি কাঠামো থাকলে সঠিক আইনি পথ নির্ধারণ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইনে এমন ধারা আছে, যা ব্যবহার করে কেউ সহজেই 'র্যাবিসের অজুহাতে কুকুর নিধন' করতে পারে।
আরেকটি সমস্যার কথা জানান সিনথিয়া। তিনি এটাকে 'রিসোর্স গ্যাপ' উল্লেখ করে বলেন, 'আশ্রয়কেন্দ্রের পরিচালনা, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের কোনো স্থায়ী নীতিমালা নেই। সরকার যদি কিছু মৌলিক নির্দেশিকা বা নীতিগত কাঠামো নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে নাগরিক ও প্রাণীকল্যাণ সংগঠনগুলো অন্তত একটা আইনি গাইডলাইন অনুসরণ করতে পারবে।'
'আরেকটি বড় সমস্যা—আইনজীবীর অভাব। অনেক সময় সংগঠনগুলো জানায়, তারা আইনি সহায়তার জন্য উকিল খুঁজে পায় না। এর কারণও আছে—আমাদের লিগ্যাল এডুকেশনে এখনো প্রাণীকল্যাণ আইন সেভাবে পড়ানো হয় না,' যোগ করেন তিনি।
তাই ভবিষ্যতের জন্য আইন শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে প্রাণীকল্যাণ আইন অন্তর্ভুক্ত করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আইনজীবীদের মাধ্যমে একটি দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিমূলক নেটওয়ার্ক তৈরি করার কথা বলেন তিনি।
'সবশেষে বলব, প্রাণীকল্যাণ শুধুমাত্র নৈতিকতার বিষয় নয়—এটি আইন, নীতি, বিজ্ঞান ও মানবিকতার এক মিলনবিন্দু। তাই এই ইস্যুকে আমরা আর বিচ্ছিন্নভাবে দেখতে পারি না—বরং এটি একটি সমন্বিত আইনি ও নৈতিক কাঠামোর মধ্যেই সমাধান খুঁজতে হবে,' বলেন সিনথিয়া ফরিদ।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কুকুর ধরে ট্রাকে করে মাতুয়াইলের ল্যান্ডফিলে ফেলে দেওয়ার ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বক্তব্য শুরু করেন ব্যারিস্টার সাকিব মাহবুব। তিনি বলেন, 'খবরটি জানার পর "অভয়ারণ্য" আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। আমরা যৌথভাবে একটি পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (পিআইএল) দায়ের করি। তখন বিষয়টি কেবল প্রাণীকল্যাণ নয়, বরং রাজনৈতিক দিক থেকেও সংবেদনশীল হয়ে দাঁড়ায়। আমি বলব, এই রাজনৈতিক মাত্রাটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ—কারণ এটি আইনের প্রয়োগকে সরাসরি প্রভাবিত করে।'
এই আইনজীবী বলেন, 'প্রথমে মনে হয়েছিল, কেসটি সহজ। কিন্তু আদালতে যাওয়ার পরপরই দেখা গেল, পরিস্থিতি মোটেও তেমন নয়। কারণ কুকুর অপসারণের সিদ্ধান্তের পেছনে ছিলেন রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। পরে রাষ্ট্রের অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে অ্যাটর্নি জেনারেল স্বয়ং আদালতে হাজির হয়ে আমাদের আবেদনের বিরোধিতা করেন। এ অবস্থায় আদালতও খানিকটা বিব্রত হন। পরে "কম্প্রোমাইজ" আকারে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে।'
'এরপর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়—কিছুদিনের মধ্যেই সিটি করপোরেশনের সামনে "কুকুর নিধনের" দাবিতে কিছু লোক বিক্ষোভ করে। এই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি বলব, রাজনৈতিক পক্ষ সঙ্গে না থাকলে, প্রাণীকল্যাণ আইন কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব,' বলেন এই আইনজীবী।
২০১৪ সালে কুকুর নিধনের বিরুদ্ধে প্রথম আদালতের আদেশ হয় এবং আরেকটি মামলায় মোরগের লড়াই নিষিদ্ধ করা হয় এবং এগুলো এক ধরনের নৈতিক বিজয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সাকিব মাহবুব আরেকটি মামলা করেছিলেন হাতি নিয়ে, যার পিটিশনার ছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী জয়া আহসান। 'সেখানে আমরা একটি নীতিগত সাফল্য অর্জন করি—আদালত নির্দেশ দেন যে, ব্যক্তিপর্যায়ে আর হাতি পালনের লাইসেন্স দেওয়া যাবে না, বিদ্যমান লাইসেন্সও নবায়ন করা হবে না,' বলেন তিনি।
কিন্তু, পিআইএল করে প্রাণীকল্যাণ ইস্যুর স্থায়ী সমাধান পাওয়া সম্ভব নয় বলেও উল্লেখ করেন এই আইনজীবী।
প্রাণীকল্যাণ আইন অনুযায়ী, কর্তৃপক্ষের লিখিত অভিযোগ ছাড়া আদালত মামলা নিতে পারবে না। সাকিব বলেন, 'অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি একা নিজে মামলা করতে পারবেন না, যদি কর্তৃপক্ষ বা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল না করে। এখানেই নাগরিকদের জন্য সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা।'
'কেউ কেউ বিকল্প হিসেবে পেনাল কোডের আওতায় মামলা করেন। কিন্তু সেখানে সমস্যাটা হলো—দণ্ডবিধির যে ধারা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা নিয়ে কথা বলে, সেটি মূলত গৃহপালিত প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু রাস্তার প্রাণী বা পথ কুকুরের ক্ষেত্রে সেই ধারা প্রযোজ্য নয়,' যোগ করেন তিনি।
'এমন অবস্থায় প্রাণীকল্যাণ আইনের অধীনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানো এবং প্রয়োজনে পিআইএলের মাধ্যমে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু দুটোরই সীমাবদ্ধতা আছে—প্রথমটি কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল, দ্বিতীয়টি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়সাপেক্ষ। তবু, আপাতত এটাই আমাদের একমাত্র কার্যকর আইনি উপায়,' বলেন তিনি।
প্রাণীর মানসম্মত চিকিৎসা ও চিকিৎসা ব্যয়ের মধ্যে নৈতিক ভারসাম্য নিয়ে কথা বলেন বাংলাদেশ অ্যানিম্যাল কেয়ার সেন্টারের সিনিয়র অ্যাসসিয়েট ভেটেরিনারিয়ান নুসরাত লিজা।
তিনি জানান, ভেটেরিনারি চিকিৎসার প্রায় সব ওষুধ, সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয় বলে অনেক ব্যয়বহুল। বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থাপনা এখন বাংলাদেশে বড় একটি উদ্বেগের জায়গা।
'কেউ যখন তার পোষা প্রাণীর জন্য লাখ টাকা খরচ করেন, সেটা শুধু ভালোবাসা না—এটা একটা নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রকাশ। আর এটাও সত্য, এখন অনেক মানুষ স্ট্রে প্রাণীর জন্যও অর্থ ব্যয় করছেন—এটা এক বিশাল ইতিবাচক পরিবর্তন,' বলেন ডা. লিজা।
ভেটেরিনারি ওষুধ ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারে কঠোর নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'স্থানীয়ভাবে উৎপাদন সম্ভব হলে প্রাণীর চিকিৎসাব্যয় অনেকটাই কমে আসবে। আরেকটা বড় সমস্যা বাংলাদেশে এখনো ২৪ ঘণ্টার ভেটেরিনারি সেবা গড়ে ওঠেনি।'
তিনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা ভেটেরিনারি অনুষদগুলোতে ক্লিনিক স্থাপন ও জাতীয় স্তরে পশুচিকিৎসা শিক্ষা ও সেবা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
রাস্তাঘাটে অপেশাদার ও অদক্ষ ব্যক্তি দ্বারা প্রাণীদের চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে নুসরাত লিজা বলেন, 'অনেকের ইচ্ছাটা থাকে ভালো, কিন্তু পদ্ধতি ভুল। এই জায়গাতেই অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্টিভিস্ট, রেসকিউ গ্রুপ ও পেশাদার ভেটেরিনারিদের মধ্যে একটা নিয়মিত সমন্বয় থাকা দরকার, যেন তারা একে অপরের কাছ থেকে নির্দেশনা পায়, একসঙ্গে কাজ করে।'
বাংলাদেশে ভেটেরিনারি শিক্ষাব্যবস্থাতেও ঘাটতি আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, 'আমাদের অনেকেই আন্তর্জাতিক প্রোটোকল বা সর্বশেষ ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন জানি না। ফলে অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার হয়, ভুল চিকিৎসা হয়। এজন্য আমাদের সিলেবাস, প্রশিক্ষণ ও প্রোটোকলগুলো আপডেট করা দরকার।'
ভালো লাগা থেকে বা ব্যবসার জন্য পোষা প্রাণী ব্রিড করানোর বিষয়ে নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে তিনি অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, 'আমাদের ব্রিডিং নিয়ন্ত্রণে স্পষ্ট নীতিমালা থাকা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের কাছে প্রতিদিন এমন অনেক বিড়াল আসে যাদের অতিরিক্ত ব্রিডিংয়ের কারণে হাড়ের গঠন বিকৃত (ডরফিজম) হয়ে গেছে। খেতে পারে না, মলত্যাগে কষ্ট হয়, শ্বাস নিতে পারে না। অনেকেই কিডনি ফেইলিওরে মারা যায়।'
'ব্রিডিং করার আগে ভেটেরিনারি সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। এটা করলে প্রাণীদের অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রণা ও বিকলাঙ্গতা অনেকটাই রোধ করা যাবে,' বলেন তিনি।
প্রাণ-প্রকৃতির প্রতি নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি সহানুভূতিশীল বলে মনে করেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী জয়া আহসান। তবে অনেকের ক্ষেত্রে 'দেখনদারি' মনোভাবকে একটা বড় বাধা বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, 'আমাদের আগের প্রজন্ম থেকেও আমরা সহানুভূতি উত্তরাধিকার সূত্রে পাইনি। তারা প্রাণবৈচিত্র্য বা প্রকৃতির প্রতি কতটা সংবেদনশীল ছিলেন, সেটা খুব স্পষ্ট না। বিজ্ঞানভিত্তিক, নীতিগত ও প্রশাসনিকভাবে আমাদের প্রাণীকল্যাণের বিষয়ে ভাবতে হবে। শুধু আবেগ দিয়ে হবে না, একটা কাঠামোবদ্ধ চিন্তার জায়গা দরকার।'
মিডিয়া বা টেলিভিশন শিল্পের ক্ষেত্রেও বিষয়টা খুব প্রাসঙ্গিক বলে উল্লেখ করেন তিনি। 'যারা মিডিয়ায় কাজ করি, তারা সমাজে একটা বার্তা পৌঁছে দিতে পারি—কীভাবে সহমর্মিতা ও দায়িত্বশীলতা চর্চা করা যায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের নিজস্ব ইন্ডাস্ট্রিটাই এখনো সংগঠিত নয়,' বলেন তিনি।
জয়া বলেন, 'আমি নিজেই দেখেছি, অনেক শুটিংয়ে প্রাণীদের খারাপ অবস্থায় রাখা হয়। একবার এক সেটে একটা বানরকে এনে একটা জানালার পাশে বসানো হয়েছিল। আমাকে প্রথমে ওটা দেখানো হয়নি—চেষ্টা করা হয়েছিল আড়াল করার। কিন্তু আমি দেখার পরই প্রশ্ন করি, কেন ওভাবে রাখা হয়েছে। তারা বলে, "খাবার দিচ্ছি, ছায়ায় রেখেছি, সমস্যা কী?" কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। ওটা একটা জীব—ওরও তো আরাম, নিরাপত্তা, মর্যাদা দরকার।'
'আমি কিছুদিন আগে একটা বিদেশি ডকুমেন্টারি দেখেছি যেখানে বলা ছিল—চিত্রায়ণে ব্যবহৃত মাছের ক্ষেত্রেও প্রাণীর কষ্ট যেন না হয়, সেটা প্রমাণসহ দেখানো হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে এই ন্যূনতম বিষয়েও কোনো নীতিমালা বা গাইডলাইন নেই,' যোগ করেন তিনি।
চলচ্চিত্রে প্রাণীদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাদের কীভাবে রাখা হবে, কাজ করানো হবে, বিশ্রাম দেওয়া হবে, চিকিৎসা থাকবে কি না—এসবের একটি কাঠামো থাকা দরকার বলেও উল্লেখ করেন জয়া আহসান।
তার মতে, সচেতনতা ও সহমর্মিতাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংগঠিত করতে পারলে, সমাজ ধীরে ধীরে প্রস্তুত হবে প্রাণীকল্যাণের ধারণার সঙ্গে সহজাত হতে এবং এর জন্য এখনই কাজ শুরু করতে হবে।
গণমাধ্যমে প্রাণীদের নিয়ে সংবাদ পরিবেশন সমাজে উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি বলে মনে করেন সাংবাদিক জাফর সোবহান। তার মতে, চাঞ্চল্যকর সংবাদ না হলে বা সংবাদ দেখে ক্ষোভ তৈরি না হলে পাঠকের কাছে তার খুব একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।
জাফর সোবহান বলেন, 'দায়িত্বশীল মূলধারার গণমাধ্যমে যারা কাজ করছেন তাদের উচিত জনসাধারণকে প্রাণীদের প্রতি সহমর্মিতা তৈরি ও প্রাণী কল্যাণের বিষয়ে শিক্ষিত করার মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কারকে চ্যালেঞ্জ করা।'
'মূলধারার গণমাধ্যমের উচিত আরও ব্যাপক এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পগুলো উপস্থাপন করা। মিডিয়াকে অবশ্যই তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া যায় না, কারণ তারা যে দৃষ্টিকোণ থেকেই লেখেন না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তারা অবশ্যই কোনো একটি সিদ্ধান্তের পক্ষ নেন,' বলেন তিনি।
বর্তমানে প্রাণীদের ওপর নির্যাতনের অনেক খবরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে আসে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 'এটা মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য উপকারী হলেও ভুল তথ্যের একটা ঝুঁকি থেকে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ার একটি বড় বিপদ হলো এগুলো যাচাই করা হয় না। অনেকে আবেগে তথ্যকে অতিরঞ্জিত করে তোলে,' বলেন জাফর সোবহান।
তার ভাষ্য, মূলধারার মিডিয়ার দায়িত্ব হলো সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আসা তথ্যগুলো বারবার যাচাই করা।
প্রাণীদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ভুল খবর ছড়ালে এটা এক পর্যায়ে সমাজে গুরুত্ব হারাবে বলেও মনে করেন তিনি। 'বাংলাদেশে প্রাণীদের প্রতি একটি সহজাত, প্রবৃত্তিগত সহানুভূতি বিদ্যমান। তারা মনে করেন নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন ঠিক না। কিন্তু ভুল খবর ছড়াতে থাকলে বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করে,' বলেন তিনি।
জাফর সোবহান প্রাণীকল্যাণ বিষয়ক সংবাদের জন্য আলাদা 'বিট' চালু করা যেতে পারে বলে মনে করেন। বলেন, 'প্রাণী অধিকার ও কল্যাণের গল্পগুলো আমাদের কাছে খুবই ছোট। কিন্তু এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে আগ্রহ রয়েছে এবং এটি সংবাদপত্রের জন্য নতুন পাঠক এনে দিতে পারে।'
প্রায় দেড় ঘণ্টার এ আলোচনায় উঠে আসে, বাংলাদেশে প্রাণী কল্যাণের ক্ষেত্রে আইন, নীতি, শিক্ষা, সচেতনতা, চিকিৎসা, প্রশাসন ও গণমাধ্যম—প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু শূন্যতা রয়েছে।
প্রাণীদের বিষয়ে সংবেদনশীলতা এখন একটি বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছে। এই শূন্যতাগুলো দ্রুত পূরণে সব অংশীদারদের এখনই কাজ শুরু করা উচিত বলে মনে করছেন বক্তারা। তাদের মতে, প্রাণীকল্যাণের 'সদিচ্ছা' থেকে কাজ শুরু করে সবার সমন্বয়ে প্রাণী অধিকারের ক্ষেত্রে 'সুশাসন' প্রতিষ্ঠা করতে হবে।