বাংলাদেশের ইতিহাসে যত গণভোট
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট।গণভোট এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে ব্যালটে 'হ্যাঁ'অথবা 'না' ভোটের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত দেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত যাচাই করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই গণভোট।চলুন, এবার জেনে আসি বাংলাদেশের তিনটি গণভোটের ইতিহাস। সেইসঙ্গে জানব এবারের গণভোট প্রস্তাবের আদ্যোপান্ত।বাংলাদেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে, প্রয়...
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসে মোট তিনবার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ছিল প্রশাসনিক এবং একটি সাংবিধানিক গণভোট।
গণভোট এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে জনগণ সরাসরি অংশগ্রহণ করে ব্যালটে 'হ্যাঁ'অথবা 'না' ভোটের মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত দেয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমত যাচাই করার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই গণভোট।
চলুন, এবার জেনে আসি বাংলাদেশের তিনটি গণভোটের ইতিহাস। সেইসঙ্গে জানব এবারের গণভোট প্রস্তাবের আদ্যোপান্ত।
বাংলাদেশে প্রথম গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩০ মে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনকাজের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য। ভোটের মাধ্যমে দেশের জনগণ জানান, রাষ্ট্রপতি এবং তার নীতি ও কর্মসূচির প্রতি তারা আস্থা রাখেন কি না।
১৯৭৭ সালের ২২ এপ্রিল গণভোটের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। দেশের ২১ হাজার ৬৮৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তখন দেশের মোট ভোটার ছিলেন ৩ কোটি ৮৪ লাখ।
ফলাফলে দেখা যায়, ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়ে। এর মধ্যে 'হ্যাঁ' ভোট পড়েছিল ৯৮ দশমিক ৯ শতাংশ, 'না' ভোট ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ।
দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালের ২১ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নীতি ও কর্মসূচির বৈধতা যাচাইয়ের জন্য ছিল এই গণভোট। আস্থা থাকলে জেনারেল এরশাদের ছবিসহ 'হ্যাঁ' বাক্সে এবং আস্থা না থাকলে 'না' বাক্সে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, ভোটার অংশগ্রহণের হার ছিল ৭২ দশমিক ২ শতাংশ। এর মধ্যে 'হ্যাঁ' ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং 'না' ভোট ছিল ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরপর পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। ১৬ বছরের রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সংসদীয় পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে বিল পাস হয়।
সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।
ভোটে অংশগ্রহণের হার ছিল ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ, যেখানে ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোটার 'হ্যাঁ' ভোট দিয়ে সংসদীয় প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে ১৫ দশমিক ৬২ শতাংশ ভোটার 'না' ভোট দেন।
২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারা সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলে গণভোটের বিষয়টি সামনে আসে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে জুলাই সনদের ভিত্তিতে সংবিধান সংস্কারের বৈধতা নিশ্চিত করতে গণভোটের প্রস্তাব দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে 'জুলাই জাতীয় সনদ' বাস্তবায়নের সুপারিশমালা হস্তান্তর করা হয়।
জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং এর তফসিলে সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কারসংক্রান্ত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। এ লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইন প্রণয়ন করা হবে।
গণভোটের ব্যালটে দুটি প্রশ্ন থাকবে—আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?
ভোটারদের এই প্রশ্নের উত্তরে ব্যালট পেপারে 'হ্যাঁ' বা 'না' ভোট দিয়ে নির্ধারিত বাক্সে প্রদান করতে হবে। তফসিল-১-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কমিশনের আলোচনায় নেওয়া সংবিধানের ৪৮টি সংশোধন প্রস্তাব।
গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে এসব সংশোধনী বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের 'নোট অব ডিসেন্ট' বা ভিন্নমত সংযোজিত থাকলেও চূড়ান্ত তফসিলে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
বাস্তবায়ন আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত হবে। একইসঙ্গে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদও গঠন করা হবে, যা সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে 'গাঠনিক ক্ষমতা' প্রয়োগ করার অধিকার রাখবে।
কমিশন জানিয়েছে, বাস্তবায়ন আদেশ অনুযায়ী অনুষ্ঠিত গণভোটে যদি ইতিবাচক সম্মতি পাওয়া যায়, তাহলে সংবিধান সংস্কার বিলটি সংবিধান সংস্কার পরিষদকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
তবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে যদি সংস্কার সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে গণভোটে অনুমোদিত সংবিধান সংস্কার বিলটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে।
অন্যদিকে কমিশনের আলোচনায় নেওয়া সংবিধানের ৪৮টি সংশোধনের মধ্যে কোনো একটি বিষয়ে যদি সমর্থন থাকে বা না থাকে, তবে গণভোটে আলাদাভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই।
আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, 'জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ' জারির মাধ্যমে গণভোটে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা থাকবে।
তবে এক্ষেত্রে সংবিধান সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে 'পূর্ণাঙ্গ খসড়া বিল' অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি বাদ রাখা হয়েছে। ২৭০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতাও দ্বিতীয় বিকল্পে রাখা হয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন প্রণীত আদেশে গণভোট কীভাবে হবে এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের গঠন ও কার্যাবলি তুলে ধরা হয়েছে।
খসড়া আদেশে বলা হয়েছে, 'এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা উক্ত নির্বাচনের দিন এই আদেশ অনুসারে গণভোট অনুষ্ঠান করা হইবে।'
আদেশে বলা থাকবে, 'জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত অংশ গণভোটে উপস্থাপন করা হইবে।'
খসড়া আদেশে বলা হয়, গণভোটে উপস্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে প্রদত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ইতিবাচক বা হ্যাঁ সূচক হইলে এই আদেশ জারির অব্যবহিত পর অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণের সমন্বয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হইবে, যাহা সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) প্রয়োগ করিতে পারিবে।
'উক্ত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে এবং এই আদেশ অনুসারে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করিবেন।'
'পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে এই আদেশের তফসিল-১ এ বর্ণিত জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করিবে এবং তাহা সম্পন্ন করিবার পর পরিষদের কার্যক্রম সমাপ্ত হইবে।'
জাতীয় সংসদের জন্য নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একইসঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসেবেও শপথ করবেন, এমন বিধান খসড়া আদেশে রেখেছে ঐকমত্য কমিশন। তাদের শপথবাক্যও নির্ধারণ করা হয়েছে আদেশের দ্বিতীয় তফসিলে।