নির্বাচনের আগে সক্রিয় ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা এবং 'আন্ডারওয়ার্ল্ড'-এর সক্রিয় হয়ে ওঠার ব্যাপারে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।গত সোমবার ঢাকার ব্যস্ততম আদালত এলাকার মাত্র কয়েক গজ দূরে দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। এর মাত্র কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগের সময় গুলিতে নিহত হন অপরাধ জগতের আরেক সদস্য সারওয়ার হোসেন বাবলা। বন্দর নগরীর পুলিশ সূত্র বলছে, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে তাকে হত্যা করা হয়েছে।গত বছর আওয়ামী লীগ সরকা...
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা এবং 'আন্ডারওয়ার্ল্ড'-এর সক্রিয় হয়ে ওঠার ব্যাপারে জনমনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকার ব্যস্ততম আদালত এলাকার মাত্র কয়েক গজ দূরে দিনদুপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুনকে। এর মাত্র কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগের সময় গুলিতে নিহত হন অপরাধ জগতের আরেক সদস্য সারওয়ার হোসেন বাবলা। বন্দর নগরীর পুলিশ সূত্র বলছে, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কারাগার থেকে মুক্তি পান বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এই হত্যাকাণ্ডগুলো তাদের পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই সন্ত্রাসীদের সহযোগীরাও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদিকে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এখনো অস্ত্র চোরাচালান চলছে।
সরকার ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, আগামী মাসে তফসিল ঘোষণার কথা। রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী মনোনয়ন ও সারা দেশে অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছে। এর মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে এই ঘটনাগুলো ঘটল।
পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, এই হত্যাকাণ্ড ও গোলাগুলির ঘটনার সঙ্গে এলাকার নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিগত শত্রুতার সম্পর্ক রয়েছে এবং এর শেকড় আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। সূত্র আরও বলছে, নির্বাচনের আগে পেশিশক্তি হিসেবে ব্যবহারের জন্য কিছু রাজনৈতিক নেতা এসব অপরাধী চক্রকে মদদ দিচ্ছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, জামিনে থাকা কোনো অপরাধী নতুন করে অপরাধে জড়ালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রামের উভয় ঘটনাই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সংঘাতের ফল। তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং ঢাকার ঘটনায় জড়িতদেরকেও শিগগির গ্রেপ্তার করা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, নির্বাচনের সময় ভোটারদের ভয় দেখানো, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রচারণায় হামলা এবং ফলাফলকে প্রভাবিত করতে অপরাধী চক্রগুলোকে 'ভাড়াটে পেশিশক্তি' হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে।
এতে বলা হয়, বিদেশে থাকা বেশ কয়েকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী দেশে থাকা তাদের নেটওয়ার্কগুলো সক্রিয় করছে। রাজনৈতিক কুশীলবরা তাদেরকে ব্যবহার করছে। সূত্র জানায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, জমি দখল ও মাদকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে আবারও আধিপত্যের লড়াইয়ে নেমেছে। কিশোর গ্যাংগুলোকে তারা কাজে লাগাচ্ছে।
সরকার পরিবর্তনের পর আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, সুইডেন আসলাম, ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সানজিদুল ইসলাম ইমন, খন্দকার নাঈম ওরফে টিটন এবং খোরশেদ আলম ওরফে ফ্রিডম রাসুসহ বেশ কয়েকজন কুখ্যাত সন্ত্রাসী কারাগার থেকে মুক্তি পায়। মোল্লা মাসুদ ও টোকাই সাগরের মতো বেশ কয়েকজন বিদেশ থেকে ফিরেছে। ফিরেই তারা নিজ নিজ এলাকা পুনর্দখল, পুরোনো অনুসারীদের ডেকে পাঠানো এবং চাঁদা দাবি শুরু করেছে। স্থানীয় ক্যাডাররা এতে বাধা দিলেই সংঘাত হচ্ছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান শফিকুল ইসলাম বলেছেন, দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন ও মামুনের মধ্যে সম্প্রতি দ্বন্দ্ব বেড়েছিল। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই মামুনকে হত্যা করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ইমনের সহযোগী রনি এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দেয় এবং দুজন বন্দুকধারীকে দুই লাখ টাকা দেয়।
অপরাধ দমনে পুলিশের প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকার অপরাধ পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আছে। আগের মাসগুলোর তুলনায় ছিনতাই ও দিনদুপুরে হামলার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। পুলিশ প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগ না করেই আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখেছে।'
তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ইমন, পিচ্চি হেলাল, মোল্লা মাসুদ ও সুব্রত বাইনের নেতৃত্বে চক্রগুলো চাঁদাবাজি ও জমি দখল চালিয়ে যাচ্ছে। সুব্রত ও মাসুদ চলতি বছরের শুরুতে কুষ্টিয়ায় গ্রেপ্তার হলেও অন্যরা বিদেশে পালিয়েছে।
সুব্রত বাইন একসময় মগবাজার, মতিঝিল, পল্টন ও মালিবাগে প্রভাবশালী থাকলেও তার গ্রেপ্তারের পর জিসান গ্রুপ এখন মালিবাগ, মতিঝিল, মগবাজার, বাড্ডা ও মহাখালী নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা বড় বড় চুক্তি, জমি ও ব্যবসা থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করছে।
অন্যদিকে, বিদেশ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, জিগাতলা, হাজারীবাগ ও নিউমার্কেটের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা গেছে। তার মূল সহযোগী রনি, কাল্লু ও শহীদুল বেরাইখালি থেকে রায়েরবাজার পর্যন্ত চাঁদা তোলে। রায়েরবাজার কবরস্থানের কাছে সাদেক খান ঘাট মুরগির বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ইমনের সহযোগীরা পাইকারি বাজার থেকে জোর করে চাঁদা নিত, এমনকি মুরগিও নিয়ে যেত। চলতি বছরের শুরুতে আমরা মাসে এক লাখ টাকা দিতে রাজি হই এবং এরপর থেকে নিয়মিত দিচ্ছি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, পাইকপাড়া, কল্যাণপুর, আদাবর ও মোহাম্মদপুরের কিছু অংশে পিচ্চি হেলালের গ্রুপ ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা তোলে। মিরপুর-১ ও শাহ আলীতে স্থানীয় ব্যবসা, ঠিকাদারি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করে বিদেশে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাতের সহযোগীরা।
মিরপুর-১০, ১৩, ১৪, ইব্রাহিমপুর, কচুক্ষেত ও ভাসানটেকে কিলার আব্বাস ও ইব্রাহিমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ঠিকাদারদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভাসানটেক ও মিরপুর-১৩-তে, ইব্রাহিমের সহযোগীরা বাড়তি দামে নির্মাণসামগ্রী কিনতে ঠিকাদারদের বাধ্য করে।
চট্টগ্রামে, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ বিদেশ থেকে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে।
সাজ্জাদ একসময় তার সহযোগী সারওয়ার হোসেন বাবলা ও আকবর আলী ওরফে ঢাকাইয়া আকবরের মাধ্যমে আধিপত্য চালাত। এক দশক আগে দুজনই আলাদা গ্যাং তৈরি করে। গত ৫ নভেম্বর বন্দর নগরীর পাঁচলাইশ এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণার সময় সারওয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২৩ মে আকবরকে পতেঙ্গায় হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, দুটি হত্যাকাণ্ডই সাজ্জাদের আদেশে হয়েছে। পুলিশ সূত্র মতে, গত বছরের আগস্ট থেকে ১০টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার গ্রুপ জড়িত।
সারওয়ার হত্যাকাণ্ড ছাড়াও, গত মাসে চট্টগ্রামের রাউজানে আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল হাকিম ও যুবদল কর্মী মোহাম্মদ আলমগীরকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
সব হত্যাকাণ্ডে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে অবৈধ পিস্তল, রিভলভার, রাইফেল ও সাবমেশিনগান ছড়িয়ে পড়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে জমা দেওয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কমপক্ষে ১৮টি সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান দিয়ে নিয়মিত অবৈধ অস্ত্র ঢুকছে। সবচেয়ে সক্রিয় পয়েন্টগুলোর মধ্যে রয়েছে টেকনাফ, বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর ও মেহেরপুর।
১ আগস্ট থেকে ৯ নভেম্বরের মধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ১৮৯টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার এবং ৯৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে সীমান্ত থেকে ১,২২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থানা থেকে লুট হওয়া ১,৩০০টিরও বেশি আগ্নেয়াস্ত্র এখনো নিখোঁজ। এর অনেকগুলোই এখন অপরাধীদের হাতে এবং সারা দেশে অপরাধ কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ৫ আগস্টের পরিবর্তনের পর কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এখন তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে।
পুলিশ এর আগে এসব অপরাধীকে নজরদারিতে রাখার কথা বললেও, অধ্যাপক ফারুক প্রশ্ন তোলেন তা কীভাবে সম্ভব। প্রতিদিন এত বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে। পুলিশের নজরদারির সক্ষমতার অভাব রয়েছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এই মুহূর্তে, চিহ্নিত অপরাধীদের পুনরায় গ্রেপ্তার করতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের অবশ্যই অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। অন্যথায়, আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা কমবে, যা দেশকে আরও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে।'