একসময় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত, ছিল না কোনো ঘর বা ঠিকানা। আজ তারা ক্লাসরুমে বসে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে প্রতিটি শিশুর অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে।

রোববার এই শিশুরাই আলোচনার টেবিলে নীতিনির্ধারক, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রশ্ন করে তাদের অধিকার, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে।

বেসরকারি সংগঠন 'লিডো'র উদ্ধার ও পুনর্বাসন করা প্রায় ১৫ শিশু অংশ নেয় দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায়। আইনি সুরক্ষা, রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের ব্যবহার থেকে শুরু করে শিক্ষা-আশ্রয়ের অধিকারসহ নানা বিষয়ে সুচিন্তিত প্রশ্ন তোলে।

আলোচনার শিরোনাম ছিল 'শৈশব থেকেই বঞ্চিত: ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের সুরক্ষায় তরুণ সাংবাদিক চেঞ্জমেকারদের আহ্বান'। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন এবং শিশুদের প্রশ্নের জবাব দেন।

শিক্ষার্থীরা নিজেদের 'লিডো'র সন্তান হিসেবে পরিচয় দেয়। ২০০০ সাল থেকে পথশিশুদের জীবন পরিবর্তনের জন্য কাজ করে আসছে এই অলাভজনক এনজিওটি। আলোচনায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা লিডো'র 'ইয়ং জার্নালিস্ট চেঞ্জমেকার' গ্রুপের সদস্য।

রুদ্র কর্মকার লিডোর সহায়তায় শিক্ষাজীবন শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি জানতে চান, যদি কোনো পথশিশুকে পুলিশ হয়রানি করে, তার আইনি প্রতিকার কী?

ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব সোশ্যাল ওয়ার্কের সহযোগী অধ্যাপক ড. হাসান রেজা বলেন, 'এ বিষয়ের নির্দিষ্ট কোনো আইনি প্রতিকার নেই। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তারাই শিশুদের হয়রানি বা নিপীড়ন করে। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগী শিশুরা যদি উচ্চপদস্থ কোনো কর্মকর্তার কাছে যেতে পারে, তবেই সহায়তা পাবে।'

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী হাসান আলী মুসাফির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শিশুদের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। জানতে চায়, এর প্রতিকার কী?

জবাবে ন্যাশনাল লিগাল এইড সার্ভিসেসের সহকারী পরিচালক আরিফা চৌধুরী হিমেল বলেন, 'রাজনৈতিকসহ কোনো অনৈতিক কাজে শিশুদের যুক্ত করার সুযোগ নেই।'

ন্যাশনাল লিগাল এইড সার্ভিসেস বিনা খরচে আইনি সহায়তা দেয় এবং শিশুদের জন্য বিশেষ অগ্রাধিকার রয়েছে। প্রয়োজনে দেশের ৬৪ জেলায় সংস্থাটির অফিসে যোগাযোগের পরামর্শ দেন আরিফা চৌধুরী।

আরেক শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার জানতে চায়, শিশু উদ্ধার কার্যক্রম সার্বক্ষণিকভাবে চালু আছে কিনা?

উত্তরে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ফরিদ আহমেদ মোল্লা বলেন, 'আমাদের অনলাইন হেল্পলাইন ১০৯৮ খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা। যদিও এর সেবা এখনো বিভাগীয় শহরেই সীমিত। শিগগির এটা জেলা-উপজেলা পর্যায়ে চালুর পরিকল্পনা আছে।'

জেসমিন আক্তারের প্রশ্ন—শিশু অধিকার রক্ষার আইন কেন ঠিকমতো কার্যকর হচ্ছে না?

জবাবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, 'মূল সমস্যা হলো দায়বদ্ধতার অভাব, সরকারি কর্মকর্তাদের অনীহা ও প্রচলিত আইনে অস্পষ্টতা। যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাদের জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা নেই।'

তিনি আরও বলেন, 'যেকোনো শিশুরই রাস্তায় ঘুমানো মানবাধিকার পরিপন্থী।'

একে অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে সরকারকে আরও আশ্রয়কেন্দ্র ও ড্রপ-ইন সেন্টার স্থাপনের আহ্বান জানান তিনি।

লিডোর আরেক সদস্য তাহমিনা আক্তার পথশিশুদের প্রতি সহমর্মিতা ও দায়িত্ববোধ বাড়ানোর উপায় জানতে চান।

এ ব্যাপারে 'সুধা' সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক মো. রেজাউল করিম খোকন বলেন, 'এটা সহানুভূতির বিষয় নয়—সমাজের দায়িত্ব। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জুলাই গণঅভ্যুত্থান—প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে পথশিশুরা। তারা কেন করুণা চাইবে?'

পথশিশুরাও কর দেয়। খাবার বা নিত্যপণ্য কিনে পরোক্ষ কর দেয় তারা, যা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তুকি পায়। তাই তাদের প্রতি সবার দায়িত্ব আছে বলে উল্লেখ করেন মো. রেজাউল করিম খোকন।

লিডোর সদস্য মাহফুজা সুলতানা মুন্নি জানান, তারা গত এক বছর ধরে পথশিশুদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ শৈশব নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

আলোচনায় অংশ নেন সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের উপ-পরিচালক এএসএম রহমত উল্লাহ ভূঁইয়া, ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পরিচালক রাহুল ম্যাথিউ নিম্মাগাড্ডা, বাংলাদেশ লিগাল এইড অ্যান্ড সার্ভিস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনি উপদেষ্টা এসএম রেজাউল করিম, ব্লাস্টের কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ ফারজানা ফাতেমা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল মোমেন চৌধুরী এবং লিডোর বোর্ড সদস্য তুষার আহমেদ ইমরান।

আলোচনাটি পরিচালনা করেন দ্য ডেইলি স্টারের এনজিও ও ফরেন মিশন ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত তানজিম ফেরদৌস।