চট্টগ্রামে চাঞ্চল্যকর চার হত্যা: পুলিশের তদন্তে অগ্রগতি নেই
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরে একের পর এক গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশকে (সিএমপি) এখনো দৃশ্যমান তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।বেশিরভাগ ঘটনাতেই এখনো পর্যন্ত পুলিশ হত্যাকাণ্ডের প্রধান শুটারদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। উদ্ধার করতে পারেনি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রও। অন্তত চারটি বড় ধরনের প্রকাশ্যে সংঘটিত গুলিবর্ষণ মামলায় এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের অগ্রগতি দেখা যায়নি। পুলিশের একাধিক সূত্রে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।নাম প্রক...
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম নগরে একের পর এক গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নগরীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশকে (সিএমপি) এখনো দৃশ্যমান তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
বেশিরভাগ ঘটনাতেই এখনো পর্যন্ত পুলিশ হত্যাকাণ্ডের প্রধান শুটারদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। উদ্ধার করতে পারেনি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোনো অস্ত্রও। অন্তত চারটি বড় ধরনের প্রকাশ্যে সংঘটিত গুলিবর্ষণ মামলায় এখনো পর্যন্ত কোনো ধরনের অগ্রগতি দেখা যায়নি। পুলিশের একাধিক সূত্রে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর মধ্যে দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরাই পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হওয়ায় তদন্তের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আগ্রহও কম দেখা গেছে।
আকবর হত্যা মামলা
গত ২৫ মে পতেঙ্গায় দিনে দুপুরে মো. আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবরকে প্রকাশ্যে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আকবর মারা যান। আকবর নগরীর বায়েজিদ এলাকার পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, আকবরের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র ও চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে।
আকবরের সঙ্গে বায়েজিদ এলাকার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদের দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল। হত্যার আগে আকবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বড় সাজ্জাদ ও তার সহযোগী ছোট সাজ্জাদকে সমালোচনা করে কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। বড় সাজ্জাদ চট্টগ্রামের আলোচিত 'আট হত্যা মামলার' আসামি ছিলেন। বর্তমানে তিনি পলাতক।
পুলিশ ধারণা করছে, আকবর হত্যাকাণ্ড ছিল তাদের গ্যাংয়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধের ফল।
ঘটনার পর আকবরের পরিবার পতেঙ্গা থানায় ১১ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে। র্যাব এরই মধ্যে বড় সাজ্জাদের ভাই ওসমান আলী ও ভাতিজা আলভিনকে গ্রেপ্তার করে পরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এরপর থেকেই কার্যত মামলার তদন্ত থমকে রয়েছে।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক অমিতাভ দাস বলেন, 'হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুজন বর্তমানে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র এখনো পর্যন্ত উদ্ধার করা যায়নি।'
তিনি আরও বলেন, 'আকবরকে কাছ থেকে পিস্তল দিয়ে দুটি গুলি করা হয়। আধিপত্য বিস্তারের বিরোধের জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে তদন্তে আমরা নিশ্চিত হয়েছি।' তবে সিসিটিভি ফুটেজ না থাকায় শুটারদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি বলে জানান তিনি।
সরোয়ার হত্যা মামলা
চট্টগ্রামের চালিতাতলী এলাকায় ৫ নভেম্বর গুলিতে নিহত হন শীর্ষ সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা। সেদিন তিনি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর সঙ্গে চট্টগ্রাম-৮ আসনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন।
হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো পর্যন্ত হত্যাকারীদের পরিচয় বা কোনো সূত্র খুঁজে পায়নি পুলিশ।
এ ঘটনায় নিহত সরোয়ারের বাবা আবদুল কাদের বায়েজিদ বোস্তামী থানায় ২২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। এরই মধ্যে পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার করলেও মামলার মূল অভিযুক্ত মোহাম্মদ রায়হান ও মোবারক হোসেনসহ কয়েকজন এখনো পলাতক রয়েছেন। এখনো পর্যন্ত হত্যার অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি।
সরোয়ারের ভাই আলমগীর বলেন, 'আমার চোখের সামনে ভাইকে গুলি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো প্রতিরোধ না থাকায় তারা নির্বিঘ্নে গুলি ছুড়ে পালিয়ে গেছে।'
ঘটনার পরদিন একই এলাকায় সিএনজি অটোরিকশার চালককে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসব ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত কোনো বিশেষ অভিযান চালানো হয়নি। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের দুই সাবেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এর আগে এ ধরনের ঘটনায় 'ব্লক রেইড' চালানো হলেও এবার তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, পুলিশের এমন নিষ্ক্রিয়তা অপরাধীদের আরও সাহসী করে তুলছে।
বাকলিয়ায় জোড়া খুন
গত ২৯ মার্চ নগরীর বাকলিয়া এলাকায় একটি প্রাইভেটকারে থাকা দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পুলিশ জানায়, তখন একই গাড়িতে সরোয়ারও ছিলেন, তবে তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে যান।
ওই ঘটনায় নিহত বখতিয়ার হোসেন (৩০) ও মো. আবদুল্লাহ (৩২) দুজনেই সরোয়ারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
নিহতদের পরিবারের দায়ের করা মামলাতেও সরোয়ার ও ছোট সাজ্জাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ বিরোধ থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত বখতিয়ারের মা ফিরোজা বেগম বাকলিয়া থানায় যে মামলা করেছেন, সে মামলায় ছোট সাজ্জাদ, তার স্ত্রী তামান্না শরীফ এবং আরও সাতজনকে আসামি করা হয়।
ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে পুলিশ ঢাকা থেকে ছোট সাজ্জাদকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তার স্ত্রী তামান্না সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দেন। পরে জুন মাসে জোড়া খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হন তামান্না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাকলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক বলেন, 'ঘটনায় এ পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে চারজন এজাহারনামীয় আসামি। ঘটনায় একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান চলছে।'
ছাত্রদল কর্মী হত্যা
গত ২৭ অক্টোবর নগরের বাকলিয়ার বগার বিলে রাজনৈতিক ব্যানার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হন জিয়াউদ্দিন চৌধুরী কলেজের ছাত্রদল কর্মী মো. সাজ্জাদ (২২)।
এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সেদিন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক বাদশা ও সাবেক সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। নিহত সাজ্জাদ ছিলেন এমদাদুলের পক্ষের সমর্থক।
পুলিশ ঘটনায় সিরাজ উল্লাহর অনুসারী বোরহান উদ্দিন ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত তাঁতী লীগ নেতা নজরুল ইসলামকে অভিযুক্ত করেছে। তবে তারা কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
বাকলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক বলেন, 'ঘটনায় আমরা এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছি ও কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছি। বাকি আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। মামলাটি এখন ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।'
সিএমপি কমিশনারের অস্বীকার
একাধিক গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটলেও কেন বন্দুকধারীরা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি—এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, 'সন্দেহভাজন অপরাধীদের অনেকে ইতোমধ্যেই কারাগারে আছে। কেউ কেউ বিদেশ থেকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বাকলিয়া জোড়া হত্যা মামলায় পুলিশ একজনকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছে।'
সিএমপি কমিশনার আরও বলেন, 'এই সন্ত্রাসীরা প্রায়শই শহরের বাইরে দূরবর্তী পাহাড়ি এলাকায় আত্মগোপন করে পাহাড়ি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছে। তারা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে দ্রুত এসে ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। আমরা তাদের ধরতে একাধিক অভিযান চালিয়েছি। তবে এখনো তাদের ধরা সম্ভব হয়নি।' পুলিশ নিষ্ক্রিয় রয়েছে—এমন অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।