জুলাই সনদ নিয়ে অচলাবস্থা: দলগুলো একমত না হলে সরকারের সিদ্ধান্ত ১৩ নভেম্বর
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অভিন্ন মতামত দিতে না পারলে বৃহস্পতিবার সরকার নিজ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেবে।সরকারের দেওয়া এক সপ্তাহের সময়সীমা শেষ হলেও সংস্কার নিয়ে গণভোটের সময়সূচি, বাস্তবায়নের আদেশ ও নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে কোনো দলই অবস্থান বদলায়নি।কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রশাসন আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করবে। তবে এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে সরকার উদ্যোগ নিয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলে...
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অভিন্ন মতামত দিতে না পারলে বৃহস্পতিবার সরকার নিজ উদ্যোগে সিদ্ধান্ত নেবে।
সরকারের দেওয়া এক সপ্তাহের সময়সীমা শেষ হলেও সংস্কার নিয়ে গণভোটের সময়সূচি, বাস্তবায়নের আদেশ ও নোট অব ডিসেন্টের বিষয়ে কোনো দলই অবস্থান বদলায়নি।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রশাসন আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করবে। তবে এই অচলাবস্থা চলতে থাকলে সরকার উদ্যোগ নিয়ে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। না পেলে ১৩ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) আমরা সিদ্ধান্ত নেব।'
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, অভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে দলগুলোকে যথেষ্ট সময় দিয়েছে সরকার।
তিনি বলেন, 'তাদের পক্ষ থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সাত দিনের মধ্যে তারা আলোচনা না করায় এখন সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে। সরকারের দায়িত্ব ও এখতিয়ার আছে এটা করার।'
তিনি আরও বলেন, 'সরকারের দরজা সব দলের জন্যই খোলা। তবে নতুন কোনো আলোচনার আমন্ত্রণ এসেছে বলে শুনিনি। আমার ধারণা, এখন সরকার নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করবে। আমাদের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা আছে।'
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, আজ মঙ্গলবার কয়েকজন উপদেষ্টা বৈঠকে বসে বর্তমান পরিস্থিতি ও বৃহস্পতিবারের উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকের আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করবেন।
৩ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার দলগুলোকে এক সপ্তাহের মধ্যে মতপার্থক্য মিটিয়ে জুলাই সনদ নিয়ে অভিন্ন মতামত দেওয়ার আহ্বান জানায়। সেদিনই বলা হয়, দলগুলো একমত হতে না পারলে সরকার 'প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।'
আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাব্য সময় নির্ধারণ করা রয়েছে ডিসেম্বরে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।
তারা সতর্ক করেছেন, এই অচলাবস্থা দেশের গভীর কাঠামোগত সংকটের প্রতিফলন, যার গঠনমূলক সমাধান না হলে নির্বাচন বিপদের মুখে পড়তে পারে।
তারা দলগুলোকে অনমনীয় অবস্থান ত্যাগ করে সমঝোতার পথে আসতে ও জাতীয় স্বার্থে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে, সংকট আরও গভীর হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা চাপ তৈরির রাজনীতি করছে এবং রাজনৈতিক কৌশলে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বল এখন সরকারের কোর্টে। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটলে প্রধান উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত নেবেন।'
'দলগুলো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখালে সেটা দেশের জন্য ভালো হবে। কিন্তু তা না হলে বাংলাদেশ নতুন সমস্যায় পড়বে। সেটার সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নির্বাচনের ওপর,' যোগ করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, 'এখন সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে। নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করার সাহস দেখাতে হবে। কেউ খুশি হবে, কেউ হবে না। কিন্তু আমার মনে হয় না কেউ নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে যাবে।'
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, সম্ভাব্য সব দিক বিবেচনা করে নিজেদের অবস্থান প্রস্তুত করতে এবং দলগুলোকে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য একদিন সময় দিতে।
তিনি বলেন, 'আমার মতে, সরকার সর্বোচ্চ এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা উচিত। ইতোমধ্যেই অনেক দেরি হয়েছে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত সব দলের স্বার্থের সঙ্গে মিলবে না, সেটি মেনে নিতে হবে।'
'এই মুহূর্তে যারা ব্যক্তিগত অহং ছাপিয়ে উঠতে পারবে, তাদের জনসম্মান বাড়বে। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা উচিত,' যোগ করেন তিনি।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক বলেন, 'সরকার স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে সরকারের জন্য বিষয়টি সহজ হতো। কিন্তু, আমার জানা মতে, সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আশা করছি দলগুলো সেটা মেনে নেবে।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত এক বা একাধিক বড় রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে যেতে পারে। এতে আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, 'সরকার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর দলগুলোকে শেষবারের মতো আলোচনার জন্য আহ্বান জানানো উচিত। নির্ধারিত কাঠামোর মধ্যে সেটা গ্রহণে উৎসাহিত করা উচিত। দলগুলোকে জাতীয় স্বার্থে সমঝোতাপূর্ণ মনোভাব ও আপসের মানসিকতা রাখতে হবে।'
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নিজেদের অবস্থানে অনড়।
ঠাকুরগাঁওয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, নির্বাচনকে ব্যাহত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, নির্বাচন স্থগিত হলে দেশ ও জনগণের জন্য বিপর্যয় নেমে আসবে। আমরা চাই অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচিত সরকার গঠনের পথে এগিয়ে যাক।
গতকাল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, সব দলই নয় মাস ধরে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু তাদের বিলম্বিত পদক্ষেপের কারণেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, জামায়াত বিএনপিকে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু তারা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবুও যদি বিএনপি আলোচনার আমন্ত্রণ জানায়, আমরা সাড়া দেব।
ঢাকায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আয়োজিত 'বিপ্লব ও সংহতি দিবস'-এর আলোচনা সভায় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যদি আমাদের আলোচনার আমন্ত্রণ জানান, আমরা যাব। কিন্তু অন্য দলের মাধ্যমে কেন আলোচনায় বসার আহ্বান জানানো হচ্ছে?
জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম আহ্বায়ক সরওয়ার তুষার জাতীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কারে ব্যর্থতার জন্য বিএনপি ও জামায়াতকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, জামায়াত বলে আঙুল বাঁকা না করলে ঘি তোলা যায় না, আর বিএনপি বলে রাজপথে নামতে হবে। দুই দলই শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা ভাবছে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি আগে ঐকমত্য কমিশন, জুলাই সনদ ও গণভোট—সবকিছুর সঙ্গেই একমত ছিল। এখন অস্বীকার করছে।
সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেন, 'জনগণের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে সরকার।'
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি না থাকলে কোনো নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়।'