নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে কচ্ছপগতিতে বিএনপি, চূড়ান্ত জামায়াতে
আগামী নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে জামায়াতে ইসলামী অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিপরীতে তাদের সাবেক জোটসঙ্গী বিএনপি এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে। জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি আর জুলাই সনদ সংস্কার নিয়ে জটিলতার কারণেই এই দেরি।নির্বাচন কমিশন এক মাসের মধ্যেই নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করতে পারে বলছে। কিন্তু বিএনপি এখনো প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।অন্যদিকে জামায়াত ইতোমধ্যে প্রার্থী বাছাই শেষ করেছে। তারা আসনভিত্তিক প...
আগামী নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে জামায়াতে ইসলামী অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিপরীতে তাদের সাবেক জোটসঙ্গী বিএনপি এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হিমশিম খাচ্ছে। জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি আর জুলাই সনদ সংস্কার নিয়ে জটিলতার কারণেই এই দেরি।
নির্বাচন কমিশন এক মাসের মধ্যেই নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা করতে পারে বলছে। কিন্তু বিএনপি এখনো প্রার্থীদের নাম চূড়ান্ত করতে পারেনি। এর ফলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে।
অন্যদিকে জামায়াত ইতোমধ্যে প্রার্থী বাছাই শেষ করেছে। তারা আসনভিত্তিক প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে এবং অনেক নতুন মুখকে প্রার্থী করেছে। এতে দলটি কৌশলগতভাবে এগিয়ে আছে বলে মনে করেন তাদের অনেক নেতা।
একসময় একই জোটে থাকা বিএনপি ও জামায়াত এখন সংস্কার বিষয়ক গণভোটের সময় নির্ধারণ নিয়ে তীব্র মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। জামায়াত চায় এই মাসেই গণভোট হোক। কিন্তু বিএনপি বলছে নির্বাচন ও গণভোট ফেব্রুয়ারির একই দিনে হওয়া উচিত।
বিএনপি চায় সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে কতটি আসন কোন দল পাবে, তা নির্ধারিত হোক নিম্নকক্ষে প্রতিটি দলের পাওয়া আসনের সংখ্যার অনুপাতে।
অন্যদিকে জামায়াত দাবি করছে, মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষের আসন ভাগ হবে, আসনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়।
বিএনপিতে বাড়ছে হতাশা
প্রার্থী চূড়ান্তে দেরি হওয়ায় বিএনপির নির্বাচনী তৎপরতা দৃশ্যমানভাবে কমে গেছে এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যেও ক্ষোভ বেড়েছে। অনেকে বলছেন, জামায়াতের প্রার্থীরা কয়েক মাস আগেই প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন।
জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি ও জুলাই সনদ সংস্কার সংক্রান্ত অবস্থানই বিএনপির এই দেরির প্রধান কারণ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান বলেন, 'বিএনপি হয়তো কৌশলগত কারণে প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করছে না। তারা এখনো জোটসঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করছে এবং জুলাই সনদের বিষয়েও আটকে আছে।'
দেশের বিভিন্ন এলাকার তিন ডজনের বেশি তৃণমূল বিএনপি নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রার্থী চূড়ান্তে দেরি হলে দলের ভেতরে বিভাজন তৈরি হতে থাকবে। বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়াবার আশঙ্কাও রয়েছে।
মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এস এ জিন্নাহ কবির বলেন, 'যত দেরি হবে, ভুল বোঝাবুঝি ততই বাড়বে এবং জটিলতা তৈরি হবে। একসময় দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙেও যেতে পারে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাতক্ষীরা-২ আসনের এক মনোনয়নপ্রত্যাশী বলেন, 'জামায়াত ছয় মাস আগেই প্রস্তুতি নিয়েছে। অথচ এখনো অনেক আসনে বিএনপির একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। দেরি হওয়ার কারণে প্রার্থীদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে।'
গত ২৪ অক্টোবর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, দলটি অক্টোবরের মধ্যেই প্রায় ২০০ আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। কিন্তু ওই সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো কোনো ঘোষণা আসেনি।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা গোপনে স্বীকার করেছেন, আসন ভাগাভাগি এখন কঠিন হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় জোটসঙ্গীদের শক্ত অবস্থান নেই।
বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, দলটি সেসব আসনই জোটসঙ্গীদের দিচ্ছে, যেখানে তাদের জয়ের সম্ভাবনা বাস্তবিকই আছে। আর এই বিষয়টাই সিদ্ধান্ত নেওয়াকে আরও জটিল করে তুলছে।
দলের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও অনেক আসনে একাধিক শক্তিশালী প্রার্থী থাকায় প্রায় ১০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্তে সময় লাগছে।
বিএনপি ইতোমধ্যে তিন ধাপে প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ করেছে। এর মধ্যে ছিল—ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের টিমের করা জরিপ, সারা দেশে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক এবং তাদের ব্যক্তিগত নথি সংগ্রহ।
দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, 'আমি আশা রাখি নভেম্বরের মাঝামাঝি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে। আমরা বড় রাজনৈতিক দল, তাই অনেক হিসাব-নিকাশ করতে হয়। হতাশ হওয়ার কিছু নেই।'
তবে দলীয় সূত্র বলছে, দেরি হলেও বিএনপি মনে করছে তারা ঠিক সময়েই ট্রেন ধরতে পারবে। কিছু নেতা অভিযোগ করছেন, জামায়াতের প্রার্থীরা বিএনপির বিরুদ্ধে "ভিত্তিহীন প্রচারণা" চালাচ্ছে। ফলে দলটি পাল্টা কৌশলও ভাবছে।
বিএনপির কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী জানান, তারেক রহমান ব্যক্তিগতভাবে তাদের ফোন করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে নীরবে প্রস্তুতি নিতে বলেছেন।
এরকমই একটি কল পেয়েছেন দাবি করা এক নেতা বলেন, 'পুরো প্রক্রিয়া গোপন রাখা হয়েছে। শীর্ষ নেতারা নির্দেশ দিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনের সময়সূচি ঘোষণার আগে কোনো তথ্য যেন প্রতিদ্বন্দ্বী মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জানানো না হয়।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপি প্রায় ২০০ আসনের প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করেছে, যাদের বেশিরভাগই ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তালিকাটি এখন দলের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যালোচনা করা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির অনুমোদন পেলেই প্রকাশ করা হবে।'
নেতারা জানান, এই ২০০ আসনের বাইরেও আরও ৬০–৭০ আসনে প্রার্থী নির্ধারণ আটকে আছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও একাধিক শক্তিশালী প্রার্থীর উপস্থিতির কারণে।
জোটে থাকা সাতটি দল বিএনপির কাছে মোট ১০৬টি আসন চেয়েছে আসন্ন নির্বাচনের জন্য। বিএনপি একটি "বৃহত্তর জোট" গঠনের চিন্তাও করছে। এই জোটে প্রায় ৫০টিরও বেশি দল থাকবে, যারা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একসঙ্গে সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
জামায়াতের আগাম প্রস্তুতি
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রাথমিকভাবে ৩০০ আসনের প্রার্থী ঠিক করেছি। সময়সূচি ঘোষণার পর চূড়ান্ত তালিকা দেওয়া হবে।'
তিনি আরও জানান, জামায়াতের মনোনীত প্রার্থীদের প্রায় ৮০ শতাংশই নতুন মুখ, যারা আগে কখনো সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। প্রায় ৬০ জনের স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে।
অনেক প্রার্থীকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতা এবং কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের ভোটে বাছাই করা হয়েছে।
পরওয়ার বলেন, 'পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও জনগণের প্রত্যাশা বিবেচনায় আমরা তরুণ নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়েছি। অনেক তরুণ ভোটার আছেন। আমাদের নতুন প্রার্থীরা দেশের জন্য কাজ করছেন, তরুণ প্রজন্মও নিশ্চয়ই এমন প্রার্থী চায়।'
জামায়াত ইতোমধ্যে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক কমিটি গঠন করেছে এবং সারাদেশে পোলিং এজেন্ট নিয়োগ সম্পন্ন করেছে।
অন্তত ১৬ জন প্রার্থী ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি, যার মধ্যে আছেন ঢাকা দক্ষিণের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ।
পরওয়ার আরও বলেন, 'ইসলামি দলগুলোর মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছে। একবার ঐক্য বা জোট চূড়ান্ত হলে কিছু আসন থেকে প্রার্থী প্রত্যাহার করা হবে।'
জামায়াত সর্বশেষ বড় সাফল্য পেয়েছিল পঞ্চম (১৯৯১) ও অষ্টম (২০০১) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। ওই দুইবারের নির্বাচনে তারা যথাক্রমে ১৮ ও ১৭টি আসনে জয়লাভ করে।
২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে দলটি আবারও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দলকে নিয়ে ইসলামি জোটের নেতৃত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।